ঊষার আলো রিপোর্ট : বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম অংশ হল উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিামাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলটি বর্তমান রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগ নিয়ে গঠিত। অর্থনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলের কৃষক প্রতিবছর দেশের মানুষের জন্য লাখ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য শস্য উৎপাদন করে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহী বিভাগে যেমন খরা এবং পানিকে কেন্দ্র করে নানা সমস্যা বিদ্যমান। তেমনি রংপুর বিভাগের বেশিরভাগ জেলাগুলো বন্যা এবং খরা উভয় সংকট বিদ্যমান। দিনে দিনে তা আরও সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সেই উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু তা না করে ইচ্ছে-খুশিমতো যে যার মতো করে এই উন্নয়ন বাস্তবায়ন হবার কারণে জনগোষ্ঠীর স্থায়ী উন্নয়ন যেভাবে এগিয়ে যাবার কথা; তা হচ্ছে না। যে উন্নয়নে জনগোষ্ঠীর মতামত এবং জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পদ্ধতি এবং সম্পদ বৈচিত্র্য এবং পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, সেটি কখনো স্থায়ী উন্নয়ন হতে পারে না। টেকসই উন্নয়নে স্থানীয় সম্পদের সাম্যের ভিত্তিতে বণ্টন ও সুরক্ষা করা একটি বড় কাজ। সেখানে সমাজের, মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু মানুষ নয়, সেই অঞ্চলের অন্যান্য প্রাণবৈচিত্র্যসহ সবককিছুকে গুরুত্ব দিতে হবে।
একটি দেশের গোটা ভূখণ্ডের কোনো অংশকে বাদ দিয়ে বা কম গুরুত্ব দিয়ে কখনো সাম্যভিত্তিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। রাজশাহী বিভাগে যেমন পানি সংকটকে কেন্দ্র করে নানা উন্নয়ন প্যাকেজ তৈরি হয়েছে, তেমনি বন্যা এবং খরাকে কেন্দ্র করে রংপুর বিভাগের উত্তরাঞ্চলকে মঙ্গা নামক একটি প্যাকেজে আবদ্ধ করে বেশিরভাগ সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিজেদের মতো উন্নয়ন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছে। উন্নয়ন বাণিজ্য হয়েছে। স্থানীয় মানুষের টেকসই উন্নয়ন কমই হয়েছে। উপরন্তু একটি জনপদের মানুষকে অক্ষম এবং শুধুই দারিদ্র্যতার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। কখনোই তাঁদের সক্ষমতা এবং স্থানীয় সম্পদের বৈচিত্র্যময় ব্যবহারের দিকগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বা সেগুলো ফোকাস করা হয়নি।
প্রতিবছরেই কম বেশি রংপুর বিভাগের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা পাড়ের মানুষগুলো বন্যার কবলে পড়ে। এটি একটি প্রাকৃতিক বিষয়ও বটে। এটিকে মোকাবেলা করেই টিকে থাকবে এই জনপদের মানুষগুলো। বন্যা মোকাবলোয় এবং বন্যা থেকে শস্য ফসল বাঁচাতে সেখানে স্থানীয় মানুষের নিজস্ব কিছু কৌশল বা তাদের নিজস্ব উন্নয়ন পদ্ধতি আছে। এসব কৌশল ও পদ্ধতি তাদের হাজার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি। এই বিষয়গুলোকে প্রোমোট এবং শক্তিশালী না করে সবসময় বাহির থেকে উন্নয়ন পদ্ধতি চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। যার ফলে বন্যা বা খরা সহনশীল শস্য ফসলের জাতগুলো এমনকি স্থানীয় অভিযোজন চর্চাগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। দিনে দিনে অন্যের উপর নির্ভরশীল একটি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। কৃষিতে কৃষকের কথা না শুনে কৃষকের জ্ঞান দক্ষতাকে গুরুত্ব না দিয়ে এই উন্নয়নের ফলে কৃষক প্রতারিত হচ্ছে অজান্তেই।
নদী ও চর এই অঞ্চলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চরের ভূখণ্ড থেকে নানা ধরনের শস্য ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু চরের শস্য ফসল এবং চর উন্নয়নে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। চরের গবেষণা কাজে গাইবান্ধার ফুলছড়ির কালাসোনা চরের কৃষক শফি মিয়া বলেন- চরের মানুষের প্রধান সমস্যা নদী ভাঙ্গন, নদী ভরাটের কারণে এখন প্রতিবছরেই চর বেশি ভাঙ্গে, আগে একটি চর জাগলে কমপক্ষে ৫ বছর স্থায়ী হত, বর্তমান প্রতিবছর চর জাগছে আর পরের বছরেই ভাঙ্গছে। এতে করে আমরা চরবাসীরা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এর কারণ হিসেবে তিনি চরের প্রাকৃতিক কাঁশবন, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংসের দিকগুলোও তুলে ধরেন। উন্নয়ন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও যেমন এই অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদে চিন্তাভাবনা কম, তেমনি দুর্যোগে দুর্ভোগে, প্রাকৃতিক সংকটে জাতীয়ভাবে এই উত্তরের জনপদের জন্য দরদও কম দেখা যায়।
প্রতি বছরের ন্যায় চলমান ভয়াবহ বন্যার সময়েও তেমনটা লক্ষ্য করা গেছে। আমরা যেমন বিশেষ কোনো অঞ্চলের বন্যায় দেশজুড়ে জেগে উঠতে পারি, তেমনি উত্তরের জনপদের জন্য পারিনি কেন? এই অসাম্য দর্শন থেকে আমারা বেরিয়ে আসতে পেরেছি? বৈষিম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে আমাদের যেমন কথার উপমা বেড়েছে, তেমনি কি আমাদের সামজিক আচরণে, কার্যকারণে বাস্তবে তা হচ্ছে? বাংলাদেশের উত্তরের বন্যা সংকট একটি দীর্ঘমেয়াদের বিষয়। যা নিয়ে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি।
এসব সংকট সমাধানে সরকারের বিগত সময়ে প্রতি বছরের উন্নয়ন বাজেটেও বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে। এই অঞ্চলের অবকাঠামো এবং কৃষি ব্যবস্থা, পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বরাদ্দও জরুরি প্রয়োজন। তা অবশ্যই এই উত্তরের জনপদের ভিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। দেশময় আমরা একই ধরনের উন্নয়ন পদ্ধতি রচনা করে বাস্তবায়ন করলে তা কোনো কোনো অঞ্চলের জন্য উপকারের থেকে ক্ষতিও ডেকে আনতে পারে। এ বিষয়য়ে গবেষণা সমীক্ষা করতে হবে। এই অঞ্চলের বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক, জনমানুষসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি বৃহৎ কার্যকর গবেষণা সেল গঠন করে জনবান্ধব একটি পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি আমরা বৈষম্যহীন একটি দেশ এবং জনপদের কথা চিন্তা ও বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে আমাদের নীতি নির্ধারণী, দুর্ভোগে-দুর্যোগে সর্বক্ষেত্রে এই অসাম্য উন্নয়ন দর্শন বাদ দিতে হবে।
ঊষার আলো-এসএ