আগামী বাজেটসহ মোট তিন অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। নানা সংকটে থাকা ভঙ্গুর অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিপুল অঙ্কের এই ঋণের লক্ষ্যমাত্রা আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেটের প্রায় সমান। এর মধ্যে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে দুলাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ফলে নগদ অর্থ সংকটের মধ্যে বড় অঙ্কের এ ঋণ চাপের মুখে পড়তে পারে ব্যাংক খাত-এমন শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। সরকারের এ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা সম্প্রতি মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো বা এমটিবিএফ (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৭-২৮)-এর আওতায় অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
প্রসঙ্গত, প্রতিবছরই অর্থ বিভাগ থেকে দেশের অর্থনীতির তিন বছরের আগাম প্রাক্কলন করা হয়। যা মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো হিসাবে পরিচিত। সেখানে পরবর্তী তিন বছরের বিভিন্ন সূচক, সরকারের আয়-ব্যয়, ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণীত এ কাঠামো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর পরবর্তী দুই অর্থবছর (২০২৬-২৭ থেকে ২০২৭-২৮) যথাক্রমে ২ লাখ ৫১ হাজার এবং ২ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। এর আগের তিন অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে এমটিবিএফ-এর আওতায় প্রথম বাজেটে (২০২৫-২৬) ঘাটতির অঙ্ক কম নির্ধারণ করলেও পরবর্তী দুই অর্থবছরের (২০২৬-২৭ এবং ২০২৭-২৮) ঘাটতি অনেক বেশি ধরা হয়েছে। অবশ্য ওই দুটি বাজেট ঘোষণা দেবেন ওই সময়ের নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার। ফলে বাজেট ঘাটতি ও ঋণ গ্রহণ সে সরকারের ওপর বর্তাবে।
জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি চেষ্টা করছি আগামী বাজেট ঘাটতি কমিয়ে রাখার জন্য। এর কারণ হচ্ছে আমাদের সম্পদ সীমিত। ঘাটতি পূরণের অর্থ সংস্থানের জন্য পরে দেশ বা বিদেশ থেকে ঋণ করতে হয়। ঋণ যাতে কম করতে হয় সেজন্য ঘাটতির পরিমাণও কমিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ঘাটতি বাজেট সাধারণত জিডিপির ৪ শতাংশ রাখার চেষ্টা করছি। যদিও ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা যায়।
এদিকে দেশের অর্থনীতিতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব খাতে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণ, বাজেট বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস অন্যতম।
সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার হতে পারে। আর ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। যে কারণে সরকারের ঋণের বোঝা কমছে না।
এদিকে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার ব্যাংকঋণের সুদ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা মূলত রাজস্ব সংগ্রহের অর্থ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ কমলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা থাকলেও ব্যাংক খাতের মতো সেখানে ঋণের অঙ্ক তেমন বাড়ছে না। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তী দুই অর্থবছরে (২০২৬-২৭ এবং ২০২৭-২৮) ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ১৫ হাজার কোটি এবং এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে ২০২৬ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ওপর চাপ পড়বে। কারণ ওই বছর থেকে মেগা প্রকল্পের বড় ঋণগুলো পরিশোধ শুরু হবে। অর্থ বিভাগ থেকে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে পরবর্তী দুই অর্থবছরে (২০২৬-২৭ এবং ২০২৭-২৮) অর্থবছরে এ ঋণ ব্যয় পর্যায়ক্রমে দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঋণের অর্থায়নে বড় প্রকল্পের বিলম্ব শুধু আকারই বাড়ায়নি, প্রকল্প থেকে অনুমিত আয় অর্জিত না হওয়ায় অন্য আয় বা ঋণ থেকে তা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সরকারকে এত বেশি ঋণ নিতে হতো না, এটাই মূল সমস্যা। আমার ধারণা, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আগামী অর্থবছরে সরকার বেশি ঋণ নেবে না; বরং সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি থেকে ভালো অর্থ সংগ্রহ করবে। গত জানুয়ারি থেকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বেড়েছে। তাই মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন।’
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুন শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। এছাড়া গত বছরের জুন শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকায়, চার বছর আগে যার পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে চার বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
ঊষার আলো-এসএ