UsharAlo logo
বৃহস্পতিবার, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা

usharalodesk
মে ২৪, ২০২১ ৩:৫৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

মোতাহার হোসেন : করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে পুরো দেশ ও দেশের মানুষ আবার অনিশ্চয়তার পথে এগুচ্ছে। ফলে নতুন করে মানুষের জীবন-জীবিকা এবং দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জর মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ ধরনের আশঙ্কার কথা বিভিন্ন গবেষক,অর্থনীতিবিদ এবং সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকেও বলা হচ্ছে।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার করোনার প্রথম ঢেউ অত্যন্ত সফলতা ও দক্ষতার সাথে সামাল দিতে  সক্ষম হয়েছে যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু করোনার প্রথম ঢেউ এর রেশ না কাটতেই শুরু হলো দ্বিতীয় ঢেউ। ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সময়ের স্বল্পতায় সরকারি মহলকে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও  দ্রুততায় সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। একই সঙ্গে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং মানুষের জীবন রক্ষা ও জীবিকার চাকা সচল ও গতিশীল রাখতে বাজেটে  ‘বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ’ আসছে। তাই করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় গৃহীত কর্মপহ্নার আদলে এবারও মানুষের জীবন-জীবিকা এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার সরকার প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এখনই কাজ শুরু করবেন এমনটি আশা করছি।

করোনার প্রথম ঢেউ এর দেশের অর্থনীতিতে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের একলাখ ২৭ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। ঘুরেছে উৎপাদনমুখী শিল্পের চাকা। একই সঙ্গে রফতানি, রেমিটেন্স এবং দেশের কৃষি খাতের উৎপাদন আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ। গত কয়েকদিনে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার প্রথম ঢেউকে ছাড়িয়ে গেছে।  করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ৫ এপ্রিল থেকে ২৩ মে পর্যন্ত ডাউনে গেছে পুরো দেশ। এমনি অবস্থায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার শুরু থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করে আসছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি পোষাতে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ব্যয় করতে হচ্ছে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ করোনার আর্থিক ক্ষতির চেয়ে গত অর্থবছরে বেশি পরিমাণ দেওয়া হয় প্রণোদনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবেলায় বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা দ্রুত বাস্তবায়নের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ঢেউ সৃষ্ট পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের নতুন প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে। প্রস্তুতি হিসেবে আগামী বাজেট সামনে রেখে নতুন কর্মসূচি নেয়ার ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসরোধে টিকা কিনতে যত টাকা লাগবে সেই পরিমাণ বরাদ্দ দিতে প্রস্তুত রয়েছে সরকার। টাকার কোনো সমস্যা নেই। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন প্রণোদনা প্যাকেজও আসতে পারে।

প্রসঙ্গত: বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম ধাক্কা শুরু হয় গত বছরের মার্চ মাস থেকে। দেওয়া হয় লকডাউন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বড়ো শিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা চরম অনিশ্চয়তায় কাটিয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের উৎপাদন খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও ওষুধসহ হাতেগোনা কয়েকটি খাতের উৎপাদন বাড়লেও কিছু খাতে ধস নামে। বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায় অথবা বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেয়। দেশের প্রধান রফতানি পণ্য এবং অর্থনীতির চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। বড়ো খাতের পাশাপাশি মহামারিতে অস্থিত্ব সঙ্কটে পড়ে কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, মাঝারি বা সিএসএমই শিল্পখাত। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০-এ এসএমই খাতে সামগ্রিকভাবে আয় কমেছে প্রায় ৬৬ শতাংশ এবং প্রায় ৭৬ শতাংশ উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত ছিল। বড়ো, মাঝারি ও ছোটো খাতগুলোর বিপর্যয়ের ফলে সরাসরি প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে সারা বিশ্বে চাকরি হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। সবমিলিয়ে করোনায় অর্থনীতিতে মোট কত ক্ষতি হয়েছে, তা বের করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ‘সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে করোনা ভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রাণহানিসহ ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ১২ বছর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকায় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের কারণে অর্থনীতি স্বল্পসময়ে কোভিডপূর্ব অবস্থায় ফিরে এসেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী চারটি নীতি কৌশল এবং পর্যায়ক্রমে ২৩টি অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর পরিমাণ এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। এটি ১৪.৬ বিলিয়ন ডলারের সমান এবং জিডিপির ৪.৪৪ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ৯টি প্যাকেজ সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত। এর মধ্যে গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ অন্যতম একটি কর্মসূচি। এই কার্যক্রম গৃহহীন ও ভূমিহীন অতিদরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনবে। অবহেলিত, বিশেষ করে নারীদের সামাজিক ক্ষমতায়ন করবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি করোনাপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। কোভিড মোকাবিলায় কী করা হয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কোভিড-১৯ জনিত অভিঘাত মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ৪টি নীতি কৌশল অবলম্বন করেন। পরবর্তীতে এর আলোকে পর্যায়ক্রমে ২৩টি অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এসময় বলা হয়, ‘বিগত ১২ বছর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকায়, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি স্বল্প সময়ে কোভিড-পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে।

২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে কত টাকা ঋণ পাওয়া গেছে, কত টাকা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে ১৫৬ কোটি ডলার ঋণচুক্তি সই করেছে সরকার। দেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর আওতায় করোনার টিকা আমদানি, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন এবং বাজেট ঘাটতি মেটানো হবে। চলতি বাজেটে বিদেশি সহায়তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা যা, গত অর্থবছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। এই অর্থ সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে বিশ্ব্যাংক গ্রুপ ও আইএমএফের সহায়তার ওপর। করোনা মোকাবিলা ও বাজেট সহায়তায় দাতাদের কাছে ঋণ চাওয়া হবে। আমাদের প্রত্যাশা করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় যে রকম অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে এবারও অনুরুপ প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে অর্থনীতি এবং মানুষের জীবন ও জীবিকার চাকা সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগী হবেন। পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে করোনা স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণ করা, গণপরিবহণ, জনসমাগম এড়িয়ে চলা আমাদের সকলের কর্তব্য। তাহলে রক্ষা পাবে দেশের অর্থনীতি এবং মানুষ। লেখক : মোতাহার হোসেন,  সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জা জার্নালিস্ট ফোরাম।

(ঊষার আলো-আরএম)