আজকের এই আলোচনার শিরোনাম হলো- “কর্মই ধর্ম”। আমরা কর্ম কী তা বুঝি, ধর্ম কী তাও মোটামোটি বুঝি। কিন্তু কর্ম কি আমার ধর্ম হতে পারে? এইজন্য ধর্ম আর কর্মের সম্পর্ক কী তাই নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। পৃথিবীতে প্রত্যেকটি পদার্থের একটি নিজস্ব ধর্ম আছে। ইংরেজীতে যাকে বলে characteristics । আমি সেই ধর্মের কথা বলছি না। আমি সনাতন ধর্মের কথা বলছি। এই ধর্মে কর্মের গুরুত্ব কতটুকু সেটাই আলোচ্য বিষয়। জীবীকার প্রয়োজনে প্রতিটি মানুষ কর্ম করে চলেছে। কর্ম করা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। বিনা কাজে কেউ বসে থাকতে পারে না। এটাই মানুষের characteristics । সনাতন ধর্মে এই কর্মকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কর্ম যখন সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয় তখন কর্মের দোষ স্খলন হয়ে যায়। সনাতন ধর্মে কর্মকেই প্রার্থনায় রূপান্তরিত করতে বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো কর্ম কী করে প্রার্থনা হতে পারে। কর্ম তো সকলেই করছে। কর্মই যদি প্রার্থনা হয়, তবে মন্দিরের দরকার কী? মন্দিরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পরে কথা বলছি। প্রথমে কর্ম কী করে উপাসনায় পরিণত হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করি। গীতায় আঠারোটি যোগের উল্লেখ থাকলেও তিনটি যোগকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তা হলো জ্ঞান, কর্ম আর ভক্তি। এই তিনটি যোগের আবার অপূর্ব সমন্বয় করা হয়েছে। এই সমন্বয়ের বিষয়কে আমি শেষ পর্যায়ে আলোচনা করবো।
প্রথমে কর্মযোগ নিয়ে আলোচনা করি। কর্ম আর কর্মযোগ দুটো পৃথক শব্দ। কর্মকে কর্মযোগে পরিণত করতে গীতায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কর্মকে যোগে রূপান্তরিত করতে হলে তিনটি কাজ করতে হবে।
প্রথম শর্ত হলো অহমিকা পরিত্যাগ। নিজের অহমিকাকে satisfy করার জন্য কাজ করা মানেই সংঘাতময় পরিবেশ তৈরী করা। প্রতিটি কাজেই আমরা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি এবং সেই শ্রেষ্ঠত্ব সুখে পরিতৃপ্ত হই। দান করে দাতা হওয়ার গর্ব অনুুভব করি, যজ্ঞ করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করি এবং সর্বত্র নিজেকে মডেল হিসেবে প্রতিপন্ন করে আনন্দ পাই। তার মানে আমার কর্মের অনুপ্রেরণা আমার অহমিকা। কর্মের অনুপ্রেরণা অহমিকার পরিবর্তে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ হওয়া দরকার। তবেই প্রথম শর্ত পূরণ হয়। গীতায় এই অহমিকা বর্জনকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা কাজ করি নিজেকে গৌরাবান্বিত করার জন্য। তাই নিজেকে নিজে অপমান করি প্রতিনিয়ত । ” নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান”- রবি ঠাকুর। তিনি তাঁর আরেকটি কবিতায় অহমিকা পরিত্যাগের অনবদ্য বর্ণনা দিয়েছেন এবং চোখের জলের বিনিময়ে অহমিকার পতন চেয়েছেন। মানুষের চরণ ধুলার তলে মাথা নত করে অহমিকার বিনাশ প্রার্থনা করেছেন। অহমিকাকে তিনি তুলনা করেছেন মলিন পোষাকের সাথে আর আহ্বান জানিয়েছেন মলিন পোষাক ছেড়ে প্রেমের বসন পরার জন্য। কবিতাটির কয়েকটি চরণ এখানে তুলে ধরি –
” এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে
হবে গো এইবার
আমার এই মলিন অহংকার।
দিনের কাজে ধুলা লাগি
অনেক দাগে হলো দাগি,
এমন তপ্ত হয়ে আছে
সহ্য করা ভার।
আমার এই মলিন অহংকার।”
কর্মের সাথে কর্মীর অহমিকা যুক্ত থাকলে সে কর্মে গৌরব থাকে না। সে কর্ম কর্মীর কর্ম বটে। কিন্তু তা মহান কর্ম হয় না। ফলে তা প্রার্থনাস্বরূপ হতে পারে না। কর্মের সুফল সকলে ভোগ করলেও কর্মীর অহমিকাকে সকলে বর্জন করে। কর্মের সাথে কর্মীর অহমিকা যোগ হলে সেই কর্ম তার greatness হারিয়ে ফেলে। গুরুদেবের সেই বিখ্যাত সোনার তরী কবিতায় একটু ফিরে দেখি। কর্মী তার সারা জীবনের রাশি রাশি অর্জন সোনার তরীতে তুলে দিলো। তরী তার সবটুকুই নিলো। যখন নিজেকে করুণা করে তুলে নিতে বললো তখন তার সেই তরীতে ঠাঁই হলো না।
” এতকাল নদীকূলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলই দিলাম তুলে থরে বিথরে-
এখন আমারে লহো করুণা ক’রে।।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি –
যাহা ছিলো নিয়ে গেলো সোনার তরী।”
পৃথিবী কর্মের সংস্কারটুকু ভোগ করে। কিন্তু ব্যক্তিগত অস্তিত্বের ভার বহনে থাকে নির্মোহ। ব্যক্তিগত অস্তিত্বের অভিমান হলো অহমিকা। এই অহমিকা পরিত্যাজ্য।
কর্মকে প্রার্থনায় পরিণত করার দ্বিতীয় শর্ত হলো কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ। This concept is very hard to understand theoretically, practically and pragmatically. কর্ম করে যদি তার ফলের প্রতি আকাঙ্ক্ষা না থাকে তবে মানুষ কাজ করবে কেন? খুবই ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন। মানুষ কাজ করে সেই কাজের ফল ভোগ করার জন্য। এটাই স্বাভাবিক। সেই প্রত্যাশায় কোনো অপরাধ নেই। তাহলে স্বাভাবিক ফলাকাঙ্ক্ষাযুক্ত কোনো কর্ম করে অস্বাভাবিক কোনো প্রতিদান পাওয়া কি সম্ভব? জীবীকার জন্য যে কর্ম করা হয় তা হলো একটি ordinary কর্ম। এই ordinary কর্ম করে তো মহত্ত্ব প্রত্যাশা করা যায় না। সেই কর্ম তো প্রার্থনায় পরিণত হতে পারে না। দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ থেকে কাজ করা আর ফলের আকাঙ্ক্ষায় কাজ করা এক নয়। যখন কেউ দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ থেকে কাজ করে সেই কর্ম হয় মহান কর্ম। প্রতিটি পিতামাতা সন্তানাদি পরিপালন করে ভালোবেসে, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে। পিতা মাতা কি প্রতিদানের প্রত্যাশায় তা করে? এটি একটি মহান কর্ম। সেই জন্য পিতামাতা শ্রদ্ধেয়। বহু দাতা দেখেছি যারা দান করে চলে যান। কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করেন না। আমরা তখন বলি কত বড় মহান দাতা। তাকে শ্রদ্ধা করি। দানও একটা কর্ম। আর দানের বিনিময়ে প্রতিদান চাইলে সেই দান কি মহত্ত্ব পায়? নিঃস্বার্থভাবে কেউ উপকার করলে তাকে কতো মহৎ বলি আমরা। উপকার করে প্রতিদান চাইলে তাতে কোনো অপরাধ হয় না। কিন্তু উপকারের মর্যাদাহানি হয়। যে কোনো পেশার মানুষ তার কাজের জন্য পারিশ্রমিক পান। সেটি তার জীবীকার জন্য প্রয়োজন। কিন্তু তিনি যখন তার কর্মকে ভালোবাসেন, সেটি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করেন এবং সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজটি করেন তখন সেই কাজ একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। নিজের কল্যাণের বাইরেও জগতের কল্যাণ তাতে হয়। এইরূপ কল্যাণকর কাজ একটি মহৎ কর্ম বলে বিবেচিত হয়। গীতায় এইরূপ কাজ করতে বলা হয়েছে। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে কাজ করা আর ফলাকাঙ্ক্ষায় কাজ করা এক জিনিষ নয়। ফলাকাঙ্ক্ষায় কৃত কাজের জন্য তার ফলপ্রাপ্তির পর আর কোনো সংস্কার থাকে না। কিন্তু নিষ্কাম চিত্তে কাজ করলে তা প্রার্থনার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে। এতক্ষণ নিষ্কাম কর্ম নিয়ে বাস্তবতার আলোকে কিছু উদাহরণ তুলে ধরলাম। এবার এর তাত্ত্বিক দিক নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই।
One who sees inaction in action and action in inaction is wise among men.
” কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেদ কর্মণি চ কর্ম যঃ।
স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্ম কৃৎ।।”
যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন এবং অকর্মে কর্ম দর্শন করেন তিনি মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমান। তিনি যোগী, তিনি সর্বকর্মকারী।
এখানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আছে। কর্ম, অকর্ম আর বিকর্ম। কর্ম মানে বিহিত কর্ম, অকর্ম মানে কর্মশূন্যতা আর বিকর্ম মানে অবিহিত কর্ম।
যিনি কাজ করেন কর্তব্যবোধে, কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা নাই এবং যিনি কর্তৃত্বাভিমান পরিত্যাগ করতে পারেন তিনি বুদ্ধিমান। তিনি কর্ম ও অকর্মে কোনো প্রভেদ দেখেন না। তিনি মনে করেন ইন্দ্রিয় সকল স্বাভাবিক নিয়মে তাদের স্ব স্ব কাজে নিয়োজিত আছে। ফলে জগত সংসারের যাবতীয় কাজে তিনি সমান মনোযোগী থাকতে পারেন। তখনই অকর্মে কর্ম আর কর্মে অকর্ম দর্শন করা যায়।
এভাবে কাজ করতে পারলে কর্ম উপাসনায় পরিণত হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত পূরণ করতেপারে।
তৃতীয় শর্তটি হলো সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ। সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য কর্মকে তাঁর পদতলে সমর্পন করা দরকার। সংসারকে আশ্রম জ্ঞান এবং নিজেকে সেই আশ্রমের একজন কর্মী মনে করতে হবে। ঈশ্বর সেবায় কর্ম করা মানে হলো জগতের কল্যাণে কাজ করা। যত জীব ততো শিব। জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিজের কর্মরাশি সমর্পিত হলে তার সুফল জগতের সকলে ভোগ করতে পারে। তাই ভগবানের পাদদেশে নিজেকে সমর্পন করে জগদ্ধিতায় ও সর্বভূতহিতেরত থেকে কাজ করলে কর্মযোগের তৃতীয় শর্ত পূরণ হয়।
যিনি কর্তৃত্বাভিমান ও অহমিকা বর্জন করেছেন, ফলাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগী ও সর্বকর্ম ঈশ্বরের সেবায় নিবেদন করতে পেরেছেন তিনি কর্মযোগী। কর্মযোগীর কর্ম হলো যজ্ঞস্বরূপ। তিনি যা করেন তাই যজ্ঞে পরিণত হয়। তিনি নিত্যসন্ন্যাসী। তার সকল কর্মই প্রার্থনাস্বরূপ। সংসার তার আশ্রম, গৃহ তার মন্দির।
একজন কর্মীর অহমিকা ও কর্তৃত্বাভিমান কি করে দূর পারে? সেটা তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষের জ্ঞান চক্ষুর উন্মেষ হলে সে জগত সংসারের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে পারে। তখন তার অহমিকা দূর হয়। জ্ঞানরূপ অস্ত্র দ্বারা সংশয়রাশি দূর করতে পারলে সে নিজেকে চিনতে পারে। তার অহমিকা চলে যায়। কর্মফলের আকাঙ্ক্ষাও দূর হয় জ্ঞান চক্ষু উন্মোচন হলে। অর্থাৎ কর্মীর কর্মযোগী হতে হলে জ্ঞানযোগের সহায়তা লাগে। জ্ঞানযোগের সহায়তা ছাড়া অহমিকা দূর করা যায় না এবং ফলাকাঙ্ক্ষাও পিছু ছাড়ে না। তাই কর্মযোগী হতে হলে জ্ঞানযোগীও হতে হয়।
তারপরে সর্ব কর্ম ঈশ্বরে সমর্পনের জন্য লাগে অন্তরে অফুরন্ত ভক্তি। তাই কর্মযোগী ও নিত্যসন্ন্যাসী হতে হলে জ্ঞানযোগী ও নিষ্ঠাবান ভক্ত হতে হয়। এই হলো জ্ঞান, কর্ম আর ভক্তির অপূর্ব সমন্বয়।
গীতার পঞ্চম অধ্যায়ে সন্ন্যাস যোগে অর্জুন ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে প্রশ্ন রেখে জানতে চেয়েছিলেন যে, কর্মত্যাগ বা সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুয়ের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ। উত্তরে তিনি জানান যে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়ই মুক্তির পথ। কিন্তু কর্মযোগ শ্রেষ্ঠ। তিনি জানালেন কর্ম ত্যাগ মানে সন্ন্যাস নয়। কর্মের ফলাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ হলো প্রকৃত সন্ন্যাস। সংসারে থেকে কর্মানুষ্ঠান করেও মানুষ সন্ন্যাসী হয়। তিনি বললেন –
” জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষন্তি।
নির্দ্বন্দো হি মহবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে।।”
অর্থাৎ ফলত্যাগী কর্মযোগী হলো প্রকৃত সন্ন্যাসী এবং তিনি নিত্যসন্ন্যাসী।
সুতরাং কর্মই প্রকৃত ধর্ম।
লেখক: প্রশান্ত কুমার রায়, সদস্য, ট্যাক্সেস এপিলেট ট্রাইব্যুনাল, বেঞ্চ-৪, ঢাকা।