UsharAlo logo
শুক্রবার, ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কলাপাড়ায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ ওটি রুম পাঁচ বছর ধরে তালাবদ্ধ

pial
অক্টোবর ৩০, ২০২২ ২:৪৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সৈয়দ রাসেল, কলাপাড়া : পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামেই শুধু ৫০ শয্যার হাসপাতাল। প্রকৃতপক্ষে ৩১ শয্যার সেবাও নেই এই হাসপাতালে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপুর্ন পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকত ঘেঁষা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও অপারেশন থিয়েটার কক্ষ এখন তালাবদ্ধ। অস্ত্রোপচার চিকিৎসক না থাকায় প্রসূতি সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক থাকলে থাকেন না গাইনি চিকিৎসক। সিজার করতে হলে এ দুইজন চিকিৎসক অবশ্যই থাকতে হবে। একজন দিয়ে কোনো ভাবেই সিজার সম্ভব নয়।

গত ৫ বছর ধরে এই হাসপাতালে এমন দুইজন চিকিৎসক এক সঙ্গে আসছেন না। তাই অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকার ফলেও সিজার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গর্ভবর্তী প্রসুতি রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ। এ উপজেলার প্রাইভেট ক্লিনিকে সিজারিয়ানের মতো অপারেশন, আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হলেও এ হাসপাতালে তার কোনো সুফলই মিলছে না। এ কারনে অপারেশন, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষা করতে ডায়াগোনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সাধারন মানুষকে হয়রানিসহ মোটা অংকের টাকা গুনতে হচ্ছে। এ উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গ্রামগঞ্জে হাফ ডজন রয়েছে ডায়াগোনস্টিক সেন্টার।

সিভিল সার্জন অফিস সনদপত্র দেখানোর নির্দেশ দিলেই, লাপাত্তা হয়ে পড়েন প্রাইভেট ডায়ানস্টিক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হাসপাতাল পয়েন্টে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাইভেট ডায়ানস্টিক সেন্টারে চলছে সিজার। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলায় প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সরকার স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারী ৩১ শয্যার এ হাসপাতাল আধুনিকায়ন করে ২০১২ সালে এ হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। মুল ভবনের পাশে আরও একটি দৃষ্টিনন্দন দু‘তলা ভবন নির্মান করে এর দু‘তলায় রয়েছে অপারেশনের সুবিধা সংবলিত একাধিক এয়ারকন্ডিশনার (এসি) যুক্ত একটি সজ্জিত অপারেশন থিয়াটার। হাসপাতাল গাইনি কনসালটেন্ট ডা. মান্নান ২০১৬ সালে কলাপাড়া হাসপাতালে যোগদান করে ২০১৭ সালে আবার বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যান।

কিন্তু সেই থেকে অপারেশন থিয়েটার আজ ৫ বছর বন্ধ রয়েছে। ফলে সরকারের লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা অপারেশনের যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যে নষ্ট হতে চলছে। প্রায় সব ধরনের পরীক্ষা করার সুযোগ থাকা সত্বেও বেশ কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম বিকল থাকায় প্রায় তিনগুন টাকা দিয়ে বাইরের ক্লিনিক থেকে রোগীদের এসব পরিক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে করে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর রোগীদের। এর মধ্যে গাইনি কনসালটেন্ট ও এনেসথেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন জটিল ও প্রসূতি রোগীরা ভিড়করলেও মিলছে না চিকিৎসাসেবা। রোগীদের অন্যত্র যেতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৩০টি। ৫ বছরেরও অধিক সময় ধরে হাসপাতালে গর্ভবতী মহিলাদের কোনো সিজার (অপারেশন) হচ্ছে না। ফলে নষ্ট হওয়ার পথে মূল্যবান যন্ত্রপাতি। কক্ষের ভেতর ধুলোবালির স্তুপ, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।

কর্তৃপক্ষ বলছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের চিকিৎসক সংকটের কারণে হচ্ছে না সিজার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত গর্ভবতী মহিলাদের সিজারের ২টি কক্ষ। কক্ষের প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। দীর্ঘদিন ধরে সিজারের কাজ নেই। তাই সেখানে নেই মানুষের পদচারণা। অপারেশন কক্ষের ভেতরে দুর্গন্ধ। মেঝেতে তেলাপোকা ও টিকটিকির পায়খানার স্তুপ। মেশিন ও যন্ত্রপাতি গুলোতেও পড়ে আছে ময়লা। এখানে কত সুন্দর সুন্দর মেশিন আছে, ডাক্তার নাই। তাই নাকি গর্ভবতী মেয়েদের অপারেশন হয় না। সরকার দিলেও আমাদের ভাগ্যে নাই। জরুরি মুহূর্তে প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে কোন নারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে পটুয়াখালী-বরিশাল হাসপাতালে রেফার করছেন। যার কারণে যাতায়াতের ভোগান্তির পাশাপাশি বিপুল অর্থ ব্যয় হয় রোগীর স্বজনদের। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বেশ কিছু বৈদ্যুতিক ফ্যান ও বাল্ব নষ্ট। শয্যাগুলোয় বিছানার চাদরে দুর্গন্ধ ও মশারি না থাকায় সন্ধ্যার পর মশার উৎপাদতে অতিষ্ট হয়ে উঠেন রোগীরা। তাই কয়েল কিনে এনে রোগীদের ঘুমাতে হয়।

বাথরুম অপরিস্কার থাকে, দরজা ভাঙ্গা, লাইটও নেই। সব মিলিয়ে হাসপাতালে ভুতুড়ে পরিবেশ। হাসপাতালের আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি ৬ বছর ধরে নষ্ট রয়েছে। গর্ভাবস্থায় মায়ের পেটের বাচ্চার বৃদ্ধি ও অবস্থান, বাচ্চাার কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না সহজেই আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে বোঝা যায়। গর্ভাবস্থার শুরুতেই অর্থাৎ মাসিক বন্ধের দুই মাস বয়স থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত। টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে ভ্রুণ প্রতি স্থাপনের চার সপ্তাহ পর। আলট্রাসনোগ্রাফি মাধ্যমে অনেক তথ্য জানা যায়।

যেমন জরায়ুর অভ্যন্তরে সঠিক স্থানে হৃৎস্পন্দন ও গর্ভসঞ্চার হয়েছে কি না নিশ্চিত করে। ভ্রুণের সংখ্যা নির্ণয় করে। সঠিকভাবে প্রসবের তারিখ নির্ণয় করে। তবে আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য ভালো মানের মেশিনের প্রয়োজন। পাশাপাশি যিনি আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করাবেন, তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু উপজেলা আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি ৬ বছর ধরে নষ্ট রয়েছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের আলট্রাসনোগ্রাম করার প্রয়োজন হলে হাসপাতাল পয়েন্টে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাইভেট ডায়ানস্টিক সেন্টারে যেতে হচ্ছে রোগীদের। ধূলাসার গ্রামের রোগী ফাতিমা বেগমের স্বজনরা জানান, ফাতিমা অসুস্থ হলে কলাপাড়া হাসপাতালে নিয়ে এসে শুনি যে হাসপাতাল গাইনি কনসালটেন্ট ও এনেসথেসিয়া চিকিৎসক নেই। এর পর তাকে পটুয়াখালী প্রাইভেট ডায়ানস্টিক সেন্টারে সিজার করতে নিয়ে যায়। কিন্তু তাতে অনেক খরচ। হাসপাতালে যদি গাইনি কনসালটেন্ট ও এনেসথেসিয়া চিকিৎসক থাকতো তাহলে আমাাদের এতো টাকাও খরচ হতো না।

কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. জেএইচ খান লেলিন জানান, এমন অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে যেখানে অস্ত্রোপচারের আধুনিক তেমন কোন যন্ত্রপাতি বা সুযোগ সুবিধা নেই, কন্তু ওই হাসপাতালে গাইনিকনসালটেন্ট ও এনেসথেসিয়া চিকিৎসক আছে, ঐসকল চিকিৎসক আমাদের এখানে দিলে অস্ত্রোপচার ঠিকভাবে হতো এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি গুলো নষ্ট হতো না।

কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিন্ময় হাওলাদার জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকাটা খুবই গুরুত্বপুর্ন এড়িয়া। ২৫০ রোগী সব সময় চিকিৎসা নিয়ে থাকে। সরকারের উন্নয়নমুলক কাজ চলছে এ অঞ্চলে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটন এলাকা হিসেবে সব সময় লোক সমাগম থাকে, তাদের কিছু হলে এ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। হাসপাতাল গাইনিকনসালটেন্ট ও এনেসথেসিয়া চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পদে চিকিৎসক সঙ্কট। আমি মাননীয় সংসদ সদস্যের ডিউ লেটার কয়েক বার জমা দিয়েছি। আমি উর্ধ্বতনকর্তৃপক্ষকে কয়েক বার জানিয়েছি কিন্তু কোন ফল দেখতেছিনা।

পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. এস এম কবির হাসান বলেন, কলাপাড়া হাসপাতাল গাইনি কনসালটেন্ট ও এনেসথেসিয়া চিকিৎসক সংকট শুধু নয় পটুয়াখালী জেলার কোন হাসপাতালে এ ডাক্তার নেই। আমরা চেষ্টা করছি ডাক্তার দেওয়ার জন্য।

(ঊষার আলো-এফএসপি)