ইতিপূর্বে সনাতন ধর্মের শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সনাতন ধর্ম কোনো একক গ্রন্থের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং তা একটি বৈদিক গ্রন্থাগারের উপর প্রতিষ্ঠিত। দুই একখানা বই পড়ে এর কুল কিনারা নির্ধারণ করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। এই বিশাল গ্রন্থ সম্ভারের মধ্যে তত্ত্ব অনুসন্ধানকারীরা প্রায়শই খেই হারিয়ে ফেলে। এই বিশাল গ্রন্থাগারের শাস্ত্রগুলিকে মূলতঃ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। শ্রুতি শাস্ত্র, স্মৃতি শাস্ত্র ও ন্যায় শাস্ত্র। সংক্ষেপে বলা হয় প্রস্থান ত্রয়ী। এরপরে সনাতন ধর্মের সর্বশেষ বিবর্তনে বৈষ্ণবীয় ধারার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরে। তিনি এবং তাঁর অনুসারী বৈষ্ণব পণ্ডিতেরা বললেন আরো একটি প্রস্থান আছে যার নাম হলো রস প্রস্থান। যেটি ছিলো সহজিয়াবাদ, মরমিয়াবাদ। শুধুই ভক্তি আর ভালোবাসা যার উপজীব্য। হিন্দু দর্শনের মধ্যে অসংখ্য মতবাদ প্রচলিত আছে। সবশেষে সেখানে একটা ঐকতানের সুরও আছে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের জন্মের কিছুকাল আগে একটি চরম বিরূদ্ধবাদী দর্শনের জন্ম হয়। এই দর্শনের প্রবক্তাগণ মূলতঃ নিরীশ্বরবাদী অর্থাৎ ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। এই নিরীশ্বরবাদের তিনটি ধারা।
১. যুক্তিবাদ ২. স্যাদবাদ ( জৈন)। ৩. শব্দবাদ ( মীমাংসা) । ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাসী মতবাদের তিনটি ধারার প্রথমটি হলো যুক্তিবাদ। এই যুক্তিবাদের আবার দুইটি ধারাঃ অনাত্মাবাদ ও আত্মাবাদ। সেই অনাত্মাবাদের দুইটি ধারাঃ বস্তুবাদ (চার্বাকদর্শন) ও অবস্তুবাদ (বৌদ্ধমত) ।
ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী মতবাদগুলো উপরে তুলে ধরা হলো। এখানে লক্ষণীয় যে, ঈশ্বর যারা মানেন না তারাও বহু মতবাদে বিভক্ত। সেই বহুধা বিভক্ত নাস্তিক্যবাদের মধ্যে বস্তবাদী দর্শন হলো চার্বাকদর্শন। এখন আমরা বুঝতে চেষ্টা করি চার্বাকদর্শন কী। চার্বাক কোনো ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়। বস্তুবাদী দর্শনকেই মূলতঃ চার্বাকদর্শন বলে অভিহিত করা হয়। চার্বাক শব্দের অর্থ চর্বনের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ। গুণরত্ন বলেছেন চার্বাক একটি সম্প্রদায়ের নাম যারা পাপ পুণ্য ও পরোক্ষ প্রমাণ মানে না। তারা বস্তবাদী, সবকিছু চর্বনের মাধ্যমে ভক্ষণ করে তৃপ্তি পায়। তাই এদের নাম চার্বাক। কেউ কেউ মনে করেন ভোগবাদী তত্ত্ব কথা শুনতে সুখকর বলেই তা চারুবাক। এই চারুবাক থেকে চার্বাক শব্দের উৎপত্তি। মাধবাচার্য তাঁর সর্বদর্শনসংগ্রহ গ্রন্থের শুরুতে বলেছেন যে চার্বাকপন্থীরা নাস্তিক শিরোমণি। মহাভারতের বন পর্বে দ্রৌপদী নাস্তিকদের সমালোচনা করে তাদেরকে চার্বাকপন্থী বলেছেন। শল্য পর্বে দূরাচারী দূর্যোধন চার্বাককে বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ চার্বাক দূরাচারীর বন্ধু। শান্তি পর্বে যুধিষ্ঠির সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে এক চার্বাক নামক রাক্ষস যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করলে উপস্থিত জনগণ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এই চার্বাকবাদ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধী ছিলো। তাই সেই সময়ে লোকে চার্বাক শব্দটিকে গালি হিসাবে ব্যবহার করতো।
চার্বাকদর্শনের মূল কথা হলোঃ
১. দেহের অতিরিক্ত কোনো আত্মা নেই যা নরকে বা স্বর্গে যেতে পারে।
২. পাপ পুণ্যের কোনো ফল নেই। দেবতা বা মোক্ষ বলেও কিছু নেই। যতদিন জীবন আছে সুখ ভোগ করাই বিধেয় কারণ মৃত্যুর পরে আর কিছু নেই। দেহ ভস্মীকৃত হলে তা আর ফিরে আসে না।
৩. জন্মান্তরবাদ মিথ্যা প্রলোভন।
৪. আত্মা বস্তুজাত, তা ঈশ্বরের অংশ নয়।
৫. তারা বেদ বিরোধী, বেদ রচয়িতাদের ধূর্ত, ভন্ড ও নিশাচর বলে গালি দিয়েছে ।
৬. চরম ভোগবাদী তত্ত্বের প্রবক্তা তারা। ঋণ করে ঘি খাওয়ার বাণী প্রচার করা হয়েছে।
৭. মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধাদি কর্মকে ব্রাহ্মণদের জীবীকার উপায় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে । তাই তা পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে।
৮. দান করাকে মূর্খের কাজ বলা হয়েছে।
৯. যজ্ঞ নিরর্থক, তাতে কোনো ফল লাভ হয় না।
বস্তবাদী বা চার্বাকপন্থী কয়েকজন দার্শনিক ছিলেন যাদের সকলের নাম জানা যায় না। সর্বশেষ দুইজন দার্শনিক হলেন অজিত কেশকম্বল ও মক্ষলি গোশাল। এরা দুইজন মূলতঃ গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের সাথে তাদের দর্শনের মিল ছিলো না। গৌতম বুদ্ধও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সুনিশ্চিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন সংশয়বাদী। তিনি অবস্তুবাদী, আর চার্বাকদর্শন হলো বস্তুবাদী।
চার্বাকদর্শনকে আরো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তা মূলতঃ সনাতন ধর্মের মূল নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তারা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, তাই পূজা বা প্রার্থনা তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। তারা ত্যাগের পরিবর্তে ভোগকেই মুখ্য মনে করে। জন্মান্তরবাদ নাকি প্রলোভন। যাগ,যজ্ঞ, পূজা নিরর্থক তাদের কাছে। দান করাকে মূর্খতা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সনাতন ধর্মের মূল নীতির শতভাগ বিপরীতে তাদের অবস্থান। শুধু সনাতন নয়, বর্তমানে বিরাজমান সকল ধর্ম মতের বিরূদ্ধে এই মতবাদ। এইরূপ একটি ভোগবাদী, নাস্তিক্যবাদী, বস্তবাদী মতবাদের জন্ম হয়েছিলো এই ভারতবর্ষেই বৌদ্ধ যুগের কিছুকাল পূর্ব থেকে। তারা সংখ্যায় বেশী ছিলো না এবং তাদের অনুসারীও বেশী ছিলো না। কিন্তু সনাতন ধর্মের উদারতান্ত্রিক মনোভাবের সুযোগ নিয়ে তাদের এই দর্শনকে তারা গর্বের সাথে প্রচার করে বেড়াতো। শুঙ্গ যুগ থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত তাদের এই মতবাদের বিরূদ্ধে সনাতনীরা দার্শনিক যুদ্ধ চালিয়ে গেছে এবং সনাতনী মতবাদের বিজয় হয়েছে। চার্বাকদর্শন সর্বজনীন কোনো কল্যাণের আদর্শ নিয়ে কাজ করেনি, বরং তা ছিলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুখ ভোগ তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই তা কালের গহ্বরে পতিত হয়েছে আবর্জনার ন্যায়।
সংগত কারণে এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে, বহু প্রাচীন ও জনগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত এই ভোগবাদী মতাদর্শ নিয়ে এখন আলোচনার দরকার কী। দরকার এই জন্য যে, সনাতন সত্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে কিছু কিছু অনুসন্ধানকারী কুহকজালে জড়িয়ে পড়ছে। বিশাল বৈদিক গ্রন্থাগারের মধ্যে এই নাস্তিক্যবাদী শাস্ত্রও পাওয়া যায়। সেই শাস্ত্র পড়ে তারা বিভ্রান্ত হয়ে কুল কিনারা করতে পারছে না। কেউ কেউ তাকেও গ্রহণযোগ্য শাস্ত্র বলে মনে করছে। শুরু হচ্ছে তার মনোজাগতিক সংঘাত। প্রকৃতপক্ষে সনাতন ধর্মশাস্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা বর্তমানে নেই। ফলে প্রাথমিক জ্ঞানসম্পন্ন একজন পাঠক উঁচু মার্গীয় কোনো শাস্ত্র পড়তে গেলে খেই হারিয়ে ফেলবেই। গুরু হিসাবে যাদের দেখতে পাই তাদেরও অধিকাংশের প্রয়োজনীয় জ্ঞানের ঘাটতি আছে। আজ থেকে সাড়ে পাঁচ শত বছর আগে নদীয়ায় হিন্দু দর্শন চর্চার প্রধান বিদ্যাপীঠ তৈরী হয়েছিলো। সারা বাংলার ছাত্ররা সেখানে বিদ্যার্জন করতে যেতো। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পিতা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র মহাশয় অধুনা বাংলাদেশের সিলেট থেকে সেখানে বিদ্যার্জনের জন্য যান। তারপর তাঁর ছেলে নিমাই সেখানে ন্যায় শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করে বিজ্ঞ নৈয়ায়িক ও তার্কিক হিসাবে ভারতজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তাকে তর্কযুদ্ধে কেউ পরাস্ত করতে পারতো না। তৎকালীন সময়ের ভারতের শ্রেষ্ঠ ন্যায় শাস্ত্রের পন্ডিত কেশব ভারতী নিমাই পন্ডিতকে তর্ক যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন। নিমাই বিনয়ের সাথে তা গ্রহণ করেছিলেন এবং তাকে পরাজিত করেছিলেন। এই ছিলো তৎকালীন সময়ের সনাতনীদের ধর্মশাস্ত্র চর্চার নমুনা যা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত। তাই সনাতনীদের ধর্মজ্ঞান আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তারা ধর্মের নাম জানে না, তাদের শাস্ত্রের নামও জানে না। সেদিন তো দেখলাম একজন নব্য বৈষ্ণব দাবীদার চার্বাকদর্শনকে তার ধর্মগ্রন্থ বলে দাবী করছে। কি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় উপনীত আমরা। আমার আজকের এই লেখাটি মূলতঃ সেই কারণে। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন মানুষের প্রধানতম সমস্যা হলো অজ্ঞতা। সেই অজ্ঞতা দূর করার জন্য তিনি জ্ঞান চর্চার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ” ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।” অর্থাৎ ইহ জগতে জ্ঞানের চেয়ে পবিত্র আর কিছু নেই। তিনি যজ্ঞের মধ্যে জ্ঞান যজ্ঞকে শ্রেষ্ঠ বলেছেন আর ভক্তের মধ্যে জ্ঞানী ভক্তকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু সনাতনীদের ধর্মজ্ঞান খুবই কম এবং এর কোনো চর্চাক্ষেত্র নাই। ধর্মগুরুদেরও প্রশিক্ষণ হওয়া দরকার। যার মনে যা আসছে সেইভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আবার নালন্দায়, আবার নদীয়ায় ফিরে যেতে হবে ভাই। নইলে পরিত্রাণের কোনো উপায় নাই।
** (বিশিষ্ট দার্শনিক রাহুল সাংকৃত্যায়ন ও সমাজ বিজ্ঞানী জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায় কর্তৃক প্রণীত গ্রন্থাদি ও গীতা এই আর্টিকেল এর তথ্যসূত্র।)
লেখক: প্রশান্ত কুমার রায়, সদস্য, ট্যাক্সেস এপিলেট ট্রাইব্যুনাল, বেঞ্চ-৪, ঢাকা।