ঊষার আলো রিপোর্ট : আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের কিছু শর্ত বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ঋণের সুদহার বাড়ানো, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকমানের করা, ডলারের দাম বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ। এতে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। সব মিলে উদ্যোক্তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তারা ইতোমধ্যে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তারা আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের বিপক্ষে কথা বলেছেন।
এদিকে আইএমএফের আগের শর্তগুলো বাস্তবায়নের ফলে বেসরকারি খাতের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উদ্যোক্তারা বলেছেন, আইএমএফের শর্তগুলো বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশের জন্য উপযোগী নয়। এসব শর্ত বাস্তবায়নের ফলে বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার আয়োজিত একাধিক অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তারা এসব কথা বলেছেন। আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের একটি ঋণ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ এটি অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে তিনটি কিস্তি ছাড় হয়েছে। চতুর্থ কিস্তির অর্থ আগামী ফেব্রুয়ারিতে ছাড় হতে পারে। তিন কিস্তিতে আইএমএফের ঋণ বাবদ বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চতুর্থ কিস্তি বাবদ ৬৪ কোটি ডলার পেতে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গত দুই বছর সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও করা হচ্ছে। তবে চলতি অর্থবছরে মুদ্রানীতি আরও কঠোর করা হয়েছে। জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে আরও কঠোর করার ইঙ্গিত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এতে ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। টানা তিন বছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার কমানোর জন্য। এ হার মোটেও কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে।
টানা তিন বছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করার ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। ঋণের প্রবাহে লাগাম টানা হয়েছে। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে নতুন শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আগের শিল্পগুলোর সম্প্রসারণ কমেছে। এতে নতুন কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আগে বছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ বাড়ত ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। এখন বাড়ছে ৯ শতাংশের মধ্যে। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ কমায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে দশমিক ৯১ শতাংশ। বিনিয়োগ কম হওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ ঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। ২০২২ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর থেকেই এ অস্থিরতা চলছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ অস্থিরতা আরও বেড়েছে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ তলানিতে পড়েছে। আগে ঋণের সুদ ছিল সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ। এছাড়া অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে উদ্যোক্তাদের চাহিদা অণুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। এতে ঋণের গতি কমেছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেছেন, বেসরকারি খাতে যেভাবে ঋণের প্রবাহ কমছে তা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।
উদ্যোক্তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির হার কমাতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো ও ঋণের সুদহার বাড়ানো হলেও এর কোনো সুফল মেলেনি। মূল্যস্ফীতি কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে ২০২২ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এখন তা বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে ওঠেছে। মূল্যস্ফীতির হার কমানোর নেওয়া উদ্যোগেও কমেনি।
আইএমএফের শর্তে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ছে। জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমছে। কিন্তু দাম বাড়ার কারণে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে সেগুলোর দাম বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। বিশেষ করে গণপরিবহণ ও ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত পরিবহণের ভাড়া কমছে না। এতে ব্যবসায়ীদের হিসাব-নিকাশে যেমন সমস্যা হচ্ছে। তেমনি দাম কমানোর সুফল পাওয়া থেকে ভোক্তারাও বঞ্চিত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, জ্বালানি উপকরণের দাম আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় করলে আমাদের বাজার এটি নিতে পারে না। কারণ এখানে সে অবকাঠামো নেই। এটি করতে হলে আগে অবকাঠামো করতে হবে। নীতি প্রণয়ন করতে হবে। সেটি নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সচেতন করতে হবে। তারপর এটি কার্যকর করলে সুফল মিলবে। এর আগে নয়।
আইএমএফ ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে বলেছে। এটি করলে ডলারের দাম উঠানামা করবে। তখন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি সমস্যায় পড়বেন। কারণ এখন ডলারের দাম একটি সীমার মধ্যে থেকে উঠানামা করে। বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে আর সীমা থাকবে না। তখন জুয়া খেলার মতো হয়ে যাবে ডলার বাজার। অসাধু চক্র ডলার মজুত করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এতে বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জিং হবে।
আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকমানের করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের শেষ দিন থেকে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে পরিশোধ না করলে তা খেলাপি হবে। উদ্যোক্তারা বলেছেন, এ নীতি বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়। কারণ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে উদ্যোক্তাদের সময় লাগছে। কারণ রপ্তানি করলে তিন মাসের মধ্যে ডলার দেশে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আমদানি করলেও তা বিক্রি করে তিন মাসের মধ্যে ঋণ শোধ সম্ভব হয় না। ফলে নতুন নীতিমালার ফলে অনেক উদ্যোক্তা খেলাপি হয়ে পড়বে। ফলে ব্যবসার গতি কমে যাবে। উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ সরকারি নীতি এখনও ব্যবসাবান্ধব ওয়ে ওঠেনি। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায়ই ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয়।
এবারের আইএমএফ মিশন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় খেলাপি ঋণের বিষয়ে আরও একটি নতুন শর্ত দিয়েছে। এতে তারা বলেছে, কোনো খেলাপি ঋণ নবায়নের পর সঙ্গে সঙ্গে তা খেলাপি মুক্ত করা যাবে না। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নবায়নের পর কমপক্ষে তিন মাস পর তাকে খেলাপি মুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে আইএমএফ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অচিরেই প্রজ্ঞাপন জারি করতে অনুরোধ করেছে। ওই তিন মাস ঋণটিকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। উদ্যোক্তারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি শোধ করছেন না। ঋণ পরিশোধে উদ্যোক্তার সক্ষমতা বা আগ্রহ রয়েছে কিনা।
উদ্যোক্তারা বলেছেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়ম বাংলাদেশে এখনই প্রয়োগ করলে ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়বে। কারণ ঋণ পরিশোধ করার পরও খেলাপি মুক্ত না করলে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা আটকে যাবে। তখন ঋণ নবায়নের অনেকেই নিরুৎসাহিত হবেন। তখন আদালতের দ্বারস্থ হয়ে নিজেকে খেলাপি মুক্ত করার চেষ্টা করবেন। যা ঋণ আদায়কে বাধাগ্রস্ত করবে।
ঊষার আলো-এসএ