ঊষার আলো প্রতিবেদক : বাগেরহাট সদর যাত্রাপুর ইউনিয়নের চাপাতলার ভুক্তভোগী বাসিন্দা লক্ষীরানী। তিনি বলেন, তার বাড়ির পাশে অবস্থিত গ্রীন বোর্ড এ্যান্ড ফাইবারস লি. নামক ফ্লাইবোর্ড কোম্পানির চারপাশে ১৪/১৫ শত লোক বাসবাস করে।
এই বেসরকারি কোম্পানীর কারণে তারা সবাই পরিবেশ বিপর্যায়ের মুখে রয়েছে। রয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। কোম্পানীর কোলো ধোয়া তেলতেলে ভাব গাছের পাতার রং অন্য রকম ধারণ করছে। প্রতিদিন দুপুরের দিকে কোম্পানী থেকে এক ধরনের দুর্গন্ধ আসে। তখন খাবার খাওয়া কস্টকর হয়ে পড়ে এলাকাবাসীর। রাস্তার উত্তরপাশে কোম্পানী আর দক্ষিণপাশে জনবসতি। তারা এ কোম্পানীর অগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন।
বাগেরহাট পরিবেশ সুরক্ষায় নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলে বড় বড় প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। উচ্ছেদ করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। কিন্তু উচ্ছেদকৃত জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে পূর্নবাসন করা হয়নি। চাপাতলায় কোম্পানীর কালো ছাই ও ধুয়া পরিবেশ চরম ক্ষতি করছে। গাছ মরে যাচ্ছে। জমির ফসল নস্ট হচ্ছে।
চাপাতলার বাসিন্দা সীমারাণী দে। তিনি পেশায় গৃহিনী। দু’ ছেলে। স্বামী আনন্দ দে ঠিকাদার। তিনি বলেন, চাপাতলায় এখন বসবাসের উপযোগী নেই। কোম্পানীর বিকট শব্দে এলাকাবাসী আতংকিত হয়ে পড়ে। কোম্পানীর কোলো ধোয়া জমিতে পড়ে। জমির শাকসবজি সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না। কালো ধোয়ায় গাছের পাতার ওপর পড়ে এক ধরনের আবরণ সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গাছের ফল মূল কোনটাই খাওয়া যাচ্ছে না। নারকেল গাছগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। গাছে তেমন নারকেল ধরছে না। কাঠের অভাবে নিউজপ্রিন্ট মিল ও হার্ডবোর্ড মিল বন্ধ হলেও চাপাতলার এ কোম্পানীতে কাঠের সরবরাহ প্রতিদিনই বাড়ছে। তারা নদী পথে নৌকা বোঝাই করে কাঠ আনছে। আর তা কোম্পানীতে কাচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কোম্পানী করার ফলে ২০ পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী আশেপাশে জমি কিনে ঘর করে বসবাস করছে। তবে পুকুরের পানিতে গোসল করার সুযোগ হারিয়েছে এলাকাবাসী। মুন্সি বাড়ির ঐতিহ্যবাহী পুকুর ভরাট করে তারা সেখানে কোম্পানী গড়ে তুলেছে। এখন এলাকাবাসী ওই গোসল করার জন্য টিউরওয়েলের পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। ওই টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত। যা ব্যবহারের অযোগ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও এলাকাবাসী বাধ্য হয়ে টিউবওয়েলের লবণ পানি সকল কাজেই ব্যবহার করছে।
তারা বলেন, উন্নয়নের নামে যে মেগা প্রকল্প হচ্ছে তাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। চাপাতলার বাসিন্দা কৃষক অশোক হালদারের স্ত্রী সুচিত্রা রাণী হালদার। দু’সন্তানের জননী। তিনি বলেন, কোম্পানীর পাশের জমিতে ছাই এসে পড়ে তা চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে করে ধান চাষ করা কস্টকর হয়ে পড়েছে। এলাকার ৫০/৬০ জন কৃষক এ প্রকট সমস্যায় ভূগছেন। এতে করে তারা বেকার হয়ে পড়ছেন। কোম্পানীর কাঠের গুড়া উড়ে আশপাশের গাছের ওপর পড়ে গাছ নস্ট হচ্ছে। পরিবেশও নস্ট হচ্ছে।
ষাটগুম্বুজ ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আকরামুজ্জামান বাচ্চু বলেন, জলাবায়ু পরিবর্তনের ফলে এলাকার চলমান চাষাবাধ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্পবিকাশের কার্বন নিসরনের কারণে ঋতু পরিবর্তনে আমুল পরিবর্তন আসছে। জলাবায়ু পরিবর্তনের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। আগামী দিনগুলো বড়ই চ্যালেঞ্চের। লবণ পানি উত্তোলন বন্ধ করে কৃষকদের পাশে দাড়াতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ খুলনার প্রতিনিধি অজান্তা দাস বলেন, এসব জীবাশ্মা জ্বালানী বন্ধ করতে হবে। অপরিকল্পিত শিল্প কারখানা স্থাপন থেকে বিরত থাকতে হবে। নাম মাত্র মূল্যে অল্প অল্প করে জমি ক্রয় করে চাপাতলায় গড়ে তোলা হয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী কোম্পানী। এ কোম্পানীর শব্দ দুষণ, বায়ু দুষণ, পরিবেশ দুষণসহ নানা কারণে ওই এলাকায় এখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এতে করে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন এবং পরিবেশ ভারসাম্য। আর এই কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে কৃষি উৎপাদন ও কৃষি ভিত্তিক পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবী জনগোষ্ঠী।
বাগেরহাট পরিবেশ সুরক্ষায় নাগরিক কমিটির সাঃ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান লিটন বলেন, বাগেরহাট অঞ্চলে মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হচেছ। একই সাথে হাজার হাজার মানুষ হচ্ছে বাস্তÍু চ্যুৎ। করা হচ্ছে না তাদের পূর্নবাসন। এসব বাস্তÍুচ্যুৎ মানুষগুলো তাদের অধিকার হারাচ্ছে। এর মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাস্তÍুচ্যুৎ হয়েছে ৫ হাজার মানুষ। আর বিমানবন্দরের জন্য ৯টি গ্রামের বাস্তÍচ্যুৎ হয়েছে ২ হাজার মানুষ। এসব মানুষ ভীড় করছে শহরে এসে। পরিচয়হীনভাবে তারা অনেকে বসবাস করছে দরিদ্রসীমার নীচে। সরকার এদের পূর্নবাসনের কথা বললেও একটি মহল তা করেনি। এ চক্রের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি নস্ট হচ্ছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. তুহিন রায় বলেন, ভূমি ও নারী অধিকার রক্ষা খুবই জরুরী। জলাবায়ু পরিবর্তন এ জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই ভয়াবহ। সবুজ পরিবেশ টিকিয়ে রাখতে হবে। সুন্দরবন যাতে নস্ট না হয় সে দিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সুন্দরবন না থাকলে এ অঞ্চলের মানুষ বসবাস করতে পারবে না। জীবাশ্ম জালানী এ অঞ্চলের চরম ক্ষতি করছে। এর ব্যবহার কমাতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিপদ হবে। জলাবায়ু পরিবর্তন সারা দেশসহ এ অঞ্চলের সমস্যা। এ জন্য সবুজ বিপ্লব করতে হবে। ম্যান মেইড ডিস্টার্ব তৈরী করছি আমরাই। খাদ্য নিরাপত্তায় ন্যাচারালভাবে খাবার উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে।
(ঊষার আলো-এফএসপি)