UsharAlo logo
শনিবার, ১৮ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

টাকা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ

ঊষার আলো রিপোর্ট
জানুয়ারি ১৮, ২০২৫ ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

টাকা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। ঘুসের টাকাও গুনে নিতেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি র‌্যাবের হাতে আটকের পর মেহেরপুরে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। ফরহাদ হোসেনের মেহেরপুরের বাড়িটি এখন জনশূন্য। দুর্দান্ত প্রতাপশালী সাবেক মন্ত্রী ফরহাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার নিজ আসনের সব শ্রেণির মানুষ।

গত ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত শহরের প্রাণকেন্দে মন্ত্রীর বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় অগণিত প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলের সারি দেখা যেত। এই বাড়িটিতে কখনো রাত নামত না। দলীয় কার্যক্রম ছাড়াও সামাজিক কার্যক্রম, বদলি-প্রমোশনের তদবির ও দেনদরবারে নারী-পুরুষের ভিড় লেগে থাকত। বাড়িটিতে হাজিরা না দিলে মন্ত্রীর আস্থা হারিয়ে যেত। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও হাজিরা দিতে বাধ্য হতেন। না হলে তাকে হতে হতো হয়রানির শিকার। জেলাজুড়ে সরকারি কর্মকর্তা, দলীয় নেতাকর্মীকে উঠতে-বসতে হতো মন্ত্রী ও তার স্ত্রী মেহেপুরের অঘোষিত ‘রানী’ সৈয়দা মোনালিসা ইসলাম শীলার নির্দেশনা মতো। সেই বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতা। ক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভের চিহ্ন সেই বাড়ির সামনে। আর এসব ক্ষোভের কারণ-দলে মারাত্মকভাবে বিভাজন তৈরি, প্রশাসনকে অধীনস্থ কর্মচারীর মতো দেখা, দলে নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে না দেওয়া, মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সব কিছু করা, ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী ও সমর্থকদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন, পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত করা, অনুগত না হলে প্রশাসনের কর্মকর্তা, সংবাদকর্মী বা দলীয় নেতার সঙ্গে কথা বন্ধ রাখা। উন্নয়নের ঠিকাদারি কাজ ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল ও দুলাভাই আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাসকে পাইয়ে দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা। এসব কারণই মন্ত্রীর রাজত্বের পতন ঘটিয়েছে। সেই দাপুটে মন্ত্রীর বাড়ির সামনে এখন নেই কোনো জনমানব। মন্ত্রীর বড়ভাই সহিদ সাদিক হোসেন বাবুল, মেজভাই শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন বুলবুল বাড়িতে অবস্থান করলেও কেউ এখন বাড়ির বাইরে আসেন না। নিকট স্বজনরা রাতের বেলা গোপনে আনাজপাতিসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে দিয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে ২০১৪ সালে বিতর্কিত ভোটে এমপি এবং ২০১৮ সালে ফের রাতের ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হন ফরহাদ হোসেন। ২০২৪ সালে তৃতীয়বারের মতো আবারও বিতর্কিত একদলীয় ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী হন তিনি। এমপি হওয়ার আগে ফরহাদ হোসেন তার বড়ভাই সাদিক হোসেন বাবুল, মেজভাই বুলবুল ও ছোট ভাই মৃদুলকে নিয়ে একটি একতলা বাড়িতে বাস করতেন। এমপি হবার আগে তাদের পরিবারের লোকজনকে রেশনের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল-আটা নিতে দেখা গেছে। এখন তাদের বহুতল বিলাসবহুল ভবন হয়েছে। বাড়ির সামনে দখল করা জায়গায় একটি অত্যাধুনিক মার্কেট। ওই মার্কেটটি ৫ আগস্ট ক্ষুব্ধ মানুষ পুড়িয়ে দিয়েছে। মন্ত্রী হওয়ার পর নিয়োগ বাণিজ্যেই হয়েছেন শত কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি এক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রী হবার পর তাকে এক ব্রিফকেস টাকা ঘুস দিলে, ব্যাংক থেকে তোলা টাকাও গুণে নিয়েছেন।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও পরে মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা কামিয়েছেন। মেহেরপুরের বারাদি ইউনিয়নের সচিব পদে কামরুজ্জামান নামে একজনকে নিয়োগ দিতে ৩৮ লাখ টাকা ঘুস নেয়ার বিষয়টি ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়। ফায়ার সার্ভিসে লোকবল নিয়োগেও নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। মন্ত্রীর স্ত্রী মোনালিসা ইসলাম শীলা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে মেহেরপুর জেলার সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনসহ কাকে কাকে জিতিয়ে আনতে হবে তা নির্ধারণ করতেন। এসব কাজে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য সব রেকর্ড ভেঙে যায়। ২০২৪ সালের ৩০ আগস্ট মেহেরপুর শহরের একটি ভাড়াবাড়ি থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রীর অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া কোটি টাকা মূল্যের ত্রাণসামগ্রী উদ্ধার করে যৌথ বাহিনী। যা থাকার কথা ছিল জেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত গোডাউনে। মেহেরপুর জেলা শহরের হাসপাতাল মোড় থেকে কুষ্টিয়া সড়কের আলমপুর পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার রাস্তা চার লেনে উন্নীত করতে ডিও লেটার দেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী। ৭৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকার অপ্রয়োজনীয় সড়কের জন্য এই ডিও লেটার বাবদ ২ কোটি টাকা মন্ত্রী ঘুস নেন বলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান।

জেলার শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও থাবা বসান মন্ত্রী। জেলা শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরি, ক্রীড়া সংস্থা, ডায়াবেটিস হাসপাতালসহ সর্বত্র তিনি নিজের অযোগ্য লোকদের বসিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ধ্বংসের পথে নিয়ে যান। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মন্ত্রীবিরোধী বলয়ের কিংবা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার ছিল না। সাবেক ডিসি আতাউল গণি, ড. মনসুর আলম খান ও শামীম হাসান মন্ত্রীর স্ত্রী মোনালিসা ইসলাম শীলার নির্দেশের বাইরে কোনো কাজ করতে পারতেন না। শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম। তিনি পূর্বসূরিদের অনুসরণ না করে ডিসি অফিসকে দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন। যুগ যুগ ধরে শহরের ভেতর গড়ে ওঠা অবৈধ ট্রাক-বাসস্ট্যান্ড পৌর টার্মিনালে স্থানান্তরসহ নানাবিধ জনবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। মন্ত্রীর রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত না হওয়ায় মন্ত্রী ও তার অনুসারীদের ক্ষুব্ধ করে। ফলে মাত্র তিন মাসের মাথায় নির্বাচনের আগেই তাকে প্রত্যাহার করে নেন।

ফরহাদ হোসেনের রাজনীতি ছিল মূলত প্রশাসন ও পুলিশনির্ভর। ২০১৪ সালের আগে এলাকার সাথে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনাভোটের নির্বাচনে হয়ে যান এমপি। ২০১৮ সালে কথিত রাতের ভোটের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হন। তৎকালীন ডিসি ড. আতাউল গণির ওপর ভর করে রাতের ভোট নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেন। প্রশাসনকে চরম দলীয়করণ তার সময়েই শুরু হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের বিরোধী দলবিহীন একপেশে নির্বাচনেও তার পছন্দের ডিসি শামীম হাসান ও এসপি রাফিউল আলমের ওপর ভর করে নির্বাচনি মাঠ সাজান।

মেহেরপুর পৌর মেয়র ও জেলা যুবলীগের আহবায়ক মাহফুজুর রহমান রিটন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল অথচ মেহেরপুর পৌরসভার দুর্ভাগ্য যে পৌরসভার উন্নয়নে জনপ্রশাসনমন্ত্রী নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। আর এর কারণ হলো মন্ত্রীর ভাইকে উন্নয়নমূলক কাজের ঠিকাদারি না দেওয়া।

দলীয় দ্বন্দ্ব প্রশ্নে দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াজান আলী বলেন, দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ সবকিছু হয়েছে মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর ইচ্ছামতো। এমনকি দলীয় পদ বণ্টন হয়েছে মন্ত্রীর স্বজনদের মধ্যে। দলের কোনো নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন করা হয়নি। আমরা সর্বশক্তিমানের কাছে বিচার প্রার্থনা করে আসছিলাম। প্রকৃতিই তার প্রতিশোধ নিয়েছে।

ঊষার আলো-এসএ