অজয় দাসগুপ্ত: ধনী দেশগুলো করোনার টিকা জোগানোর নামে আসলে মুলা দেখাচ্ছে– পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন কি ক্ষোভ প্রকাশ করলেন? না–কি হতাশার ভাগটাই বেশি? যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে ঢাকা ফিরে ২২ জুন তিনি বলেন, ধনী দেশগুলো টিকা নিয়ে বসে রয়েছে। জনসংখ্যার চেয়ে বেশি টিকা রয়েছে তাদের হাতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। এক ফাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন এভাবে– ধনী দেশগুলোর কেউ কেউ টিকা দেবে বলে। আবার একইসঙ্গে জানতে চায়– ‘অমুক জিনিসে আমাকে সমর্থন দেবেন কিনা। প্রকৃতপক্ষে টিকাকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটা কি নতুন শর্ত?
মুলা ঝুলানোর পাশাপাশি টিকা প্রদানের জন্য কী শর্ত প্রদান করা হচ্ছে? বহু বছর আমরা খাদ্য ও প্রকল্প সাহায্যের নামে নানাবিধ শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার কথা শুনেছি। যুক্তরাষ্ট্র পিএল-৪৮০ নামে পরিচিত তাদের একটি আইনের অধীনে এক সময় বাংলাদেশকে চাল–গম–তুলা–সয়াবিন তেল অনুদান দিত। কিন্তু সাহায্যের নামে তারা আদায় করে নিত ‘বিশ্বকে অনুগত রাখার নীতির’ প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন। ১৯৭৪ সালে কিউবায় মাত্র ২ লাখ ডলারের চটের বস্তা রপ্তানির ‘অপরাধে’ গম সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশটি। তাদের যুক্তি ছিল– পিএল-৪৮০ অনুদানের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ কিউবা ও ভিয়েতনামের মতো কোনো কমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে না।
১৯৮৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (তখন প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন রোনাল্ড রিগান) গ্রানাডা নামে একটি বামপন্থি সরকারশাসিত ছোট দেশে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে পছন্দের সরকার ক্ষমতায় আনে। বাংলাদেশ তখন ক্ষমতায় এইচ এম এরশাদ। সামরিক শাসন চলছে। যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে তিনি গ্রানাডায় অন্যায় সামরিক অভিযানকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। বিনিময়ে কি কোনো ‘অর্থনৈতিক সাহায্য’ পেয়েছিলেন? না–কি নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিলেন?
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ‘ঝামেলা’ মিটিয়ে ফেলতে বাংলাদেশের ভেতরেই অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে নিজস্ব অর্থে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলাদেশেরই একদল ‘অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ’ বলেছিলেন– ‘সহজ শর্তে নামমাত্র সুদে ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে তাদের কথা মতো কাজ না করলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে তারা যে ঋণ দেয় সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি চরম ঝুঁকিতে পড়বে।’
কিন্তু শেখ হাসিনা তার অবস্থানে অটল থাকেন। পরে বিশ্বব্যাংকই স্বীকার করে– তাদের ঋণ প্রদান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কেন বাংলাদেশ এমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারল? এর কয়েকটি কারণ বলা যায়– খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, বাজেট প্রণয়নে (বিশেষ করে উন্নয়ন বাজেট) নিজস্ব সম্পদের জোগান বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারা এবং সর্বোপরি শেখ হাসিনার স্বাধীনচেতা মনোভাব।
বিশ্বে করোনা–বিপর্যয় নেমে আসার পর বাংলাদেশ অর্থনীতির চাকা সচল রাখায় বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পাশাপাশি ভ্যাকসিন সংগ্রহে দ্রুত তৎপর হয়। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন– সরকার ধনী–দরিদ্র নির্বিশেষে সব নাগরিককে ভ্যাকসিন প্রদান করবে বিনামূল্যে। ভারতের সেরাম–এর সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তিও সই হয়ে যায়। এ চুক্তির আওতায় ৭০ লাখ ভ্যাকসিন দেশে এসেছে। ভারত সরকার থেকে আরও ৩৩ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন মিলেছে অনুদান হিসেবে। এই ভ্যাকসিন ভারত পৌঁছে দেয় তাদের বিমানে, তাদের খরচে। এই ভ্যাকসিন হাতে আসায় উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন প্রদান শুরু করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশী তখন বাংলাদেশের জনগণকে রীতিমতো ‘ঈর্ষা’ করতে শুরু করেন। তারা বলছিলেন– উন্নত দেশে থেকেও তারা কবে ভ্যাকসিন পাবেন, সে নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে দরিদ্ররাও প্রত্যন্ত গ্রামে কিংবা বস্তিতে বসবাস করে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পেয়ে ছবি দিচ্ছে ফেসবুকে। এই ভ্যাকসিন অভিযান চলার সময়েই রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভ্যাকসিন ক্রয়ের আলোচনা চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বাংলাদেশে ভ্যাকসিন জোগানোর অঙ্গীকার করে।
কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে যায় ভারতে করোনা সংক্রমণ বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায়। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী তারা ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তাদের কাছ থেকে ক্রয় ও উপহার হিসেবে পাওয়া ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকার মধ্যে ৪৪ লাখের মতো নাগরিককে দুই ডোজ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ১৪ লাখের মতো নাগরিক প্রথম ডোজ নেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ পাবেন কিনা, সে নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এই ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও প্রয়োগে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। যদি দ্বিতীয় ডোজ সময়মতো দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে এই বিপুল অর্থ অপচয় হবে। ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছে এখন এই মানের ভ্যাকসিন রয়েছে। কিন্তু কেউ বাংলাদেশের অনুরোধে এখন পর্যন্ত কার্যকরভাবে সাড়া দিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ জুন বলেছেন– ‘কোভিড-১৯ বিশ্ব সংহতির জন্য লিটমাস টেস্ট’। কাতার ইকোনমিক ফোরামের ভার্চুয়াল বৈঠকে দেওয়া ভাষণে তিনি সকলের উন্নয়নে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
রসায়নের সূত্র অনুযায়ী অ্যাসিড ও ক্ষার পরীক্ষার জন্য লিটমাস পেপার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের চরম বিপর্যয়ের সময়ে উন্নত বিশ্ব কি পরস্পরের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পেরেছে? সাদা চোখে আমরা বলবো, বিশ্ব লিটমাস টেস্টে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
চীনের কথাই ধরা যাক। এই দেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। বিজ্ঞানে এগিয়ে। সামরিক শক্তিতেও। করোনার সূত্রপাত সেদেশেই। তারা ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে প্রচুর পরিমাণে। এ পর্যন্ত ১০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন নিজ দেশের নাগরিকদের দিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস ১৮ জুন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ভ্যাকসিন গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য লাখ লাখ ডলারের লটারির টিকিট দিয়েছে। কিন্তু চীন দিয়েছে এক বোতল পানি কিংবা ডিম।
চীন বাংলাদেশকে ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্ম ভ্যাকসিন অনুদান দিয়েছে। এই ভ্যাকসিন চীন থেকে আনার জন্য বাংলাদেশ নিজেদের ব্যয়ে বিমান পাঠিয়েছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের পিএল-৪৮০ সাহায্যের চুক্তির শর্ত স্মরণ করতে পারি– বিনামূল্যে পাওয়া চাল–গম–সয়াবিন তেল আনতে হতো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন জাহাজে, যার ভাড়া অন্যান্য দেশের জাহাজের তুলনায় বেশি ছিল।
ভারত থেকে সময়মতো ভ্যাকসিন না পাওয়ার সুযোগও কি চীন নিচ্ছে? ২৭ মে বাংলাদেশের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন কেনার অনুমোদন দেয়। একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা অসতর্কতাবশত ভ্যাকসিনের দাম প্রকাশ করে দেন। চীন দাবি করে, এটা চুক্তির লঙ্ঘন। এ কারণে তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়া বিলম্বিত হচ্ছে। এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট যে চীনের কাছ থেকে যে দামে ভ্যাকসিন কেনা হচ্ছে, ভারতের কাছ থেকে তার অর্ধেক দামেই সেটা পেয়েছিল বাংলাদেশ। ভারতের পরিস্থিতি উন্নত হলে এই অর্ধেক দামেই বাংলাদেশ আরও ভ্যাকসিন পাবে। চীনের এ কেমন শর্ত যে বাংলাদেশ কী দামে ভ্যাকসিন কিনবে, সেটা প্রকাশ করতে পারবে না?
বাংলাদেশের গণমাধ্যম মুক্ত। সামাজিক গণমাধ্যম প্রবলভাবে সক্রিয়। বিপুল অর্থ ব্যয় করে যে ভ্যাকসিন কেনা হচ্ছে, তার দাম কি গোপন রাখা সম্ভব? চীনে রেজিমেন্টেড সমাজ। কমিউনিস্ট পার্টি একক শাসক দল। ইন্টারনেট সুযোগ কঠোরভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন কেবল সরকারের মত প্রকাশ করে। করোনা ছড়িয়ে পড়ার খবর তারা গোপন রাখতে পেরেছে। এই ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে কত লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং কতজনের মত্যু হয়েছে তার প্রকৃত খবর কোনো দিন প্রকাশ পাবে কিনা, কে জানে। বাংলাদেশের মতো ভাইব্রান্ট সমাজে এমন ভ্যাকসিন কিংবা অন্য পণ্য কেনার তথ্য কীভাবে গোপন রাখা সম্ভব?
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের ঋণ বাড়ছে। ২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি ও কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষনেতা শি জিনপিংয়ের সফরকালে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের ঘোষণা এসেছিল। পদ্মা সেতু প্রল্পের রেল সংযোগ, কর্ণফুলীর তলদেশে সড়ক পথ নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পে চীনের ঋণ রয়েছে। এই ঋণের শর্তও কি গোপান রাখার বিধান রয়েছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন কি এ সব শর্তের প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন?