ঊষার আলো রিপোর্ট : প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটের বড় ব্যবধান গড়ে খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে নগরপিতা নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার দুই প্রার্থী। খুলনায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তালুকদার আব্দুল খালেক। অন্যদিকে বরিশালে মেয়র হয়েছেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। তারা দুজনই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।
বিএনপিবিহীন দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহজেই জয় পেলেন নবনির্বাচিত দুই মেয়র। গতকাল রাতে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা ফল ঘোষণার পর উভয় সিটিতেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উৎসব-উল্লাসে মেতে ওঠেন। তারা ফুল দিয়ে বরণ করেন নবনির্বাচিত দুই মেয়রকে।
খুলনা সিটি করপোরেশনে তালুকদার আব্দুল খালেক (নৌকা) প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৯৪৭৬১ ভোট বেশি পেয়ে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন এক লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আব্দুল আউয়াল (হাতপাখা) পেয়েছেন ৬০০৬৪ ভোট। এ সিটির ২৮৯টি কেন্দ্রে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়েছে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৯৩৬টি। ভোট পড়ার হার ৪৮.১৭ শতাংশ।
অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৫৩ হাজার ৯৮০ ভোট বেশি পেয়ে বরিশালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। প্রথমবার মেয়র প্রার্থী হয়েই এ চমক দেখালেন তিনি। এ নির্বাচনে তিনি পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুফতি সৈয়দ মো. ফয়জুল করীম (হাতপাখা) পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮২৮ ভোট।
বরিশালের ১২৬টি কেন্দ্রে দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৯৭ জন ভোটারের মধ্যে ভোট পড়েছে এক লাখ ৪২ হাজার ১৭৭টি। ভোট পড়ার হার ৫১.৪৬ শতাংশ। যদিও এই দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা। তারা এই ফল বর্জন করেছেন।
সোমবার কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্র্যন্ত দুই সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
ভোট চলাবস্থায় খুলনায় কোনো ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেনি। শার্ন্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দেন নগরবাসী। তবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। অন্যদিকে বরিশালে কিছুটা ভিন্নচিত্র ছিল। ভোটকেন্দ্রের বাইরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অভিযোগ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তবে ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ভালো ছিল।
এ সিটি করপোরেশনে মুফতি সৈয়দ মো. ফয়জুল করীমের ওপর হামলার ঘটনায় পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তা নিয়ন্ত্রণে আনেন। হামলাকারী স্বপনকে রাত পৌনে নয়টায় আটক করা হয়।
গতকালের এ নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনে নতুন অধ্যায় শুরু হলো। রাজনীতি এবং বরিশাল সিটি করপোরেশন-দুজায়গাতেই নতুন খোকনকে নিয়ে শুরু থেকেই একটা সংশয় ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। তার ওপর ছিল মনোনয়নবঞ্চিত পক্ষের অসহযোগিতা। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নিজের মতো করে ভোটের মাঠে প্রচার-প্রচারণা চালান খোকন।
তাকে সহযোগিতা দেন বরিশালে আওয়ামী রাজনীতিতে মেয়র সাদিকবিরোধী হিসাবে পরিচিত নেতাকর্মীরা। বরিশালের উন্নয়ন আর শান্তির নগর স্থাপনে বিএনপির ভোটাররাও ভোট দেবে তাকে এই বিশ্বাস ছিল তার। গতকাল রাতে ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর যেন তার সেই কথারই মেলে বাস্তব প্রতিফলন। রেকর্ড গড়া ভোট নিয়ে মেয়র হলেন খোকন সেরনিয়াবাত।
অন্যদিকে খুলনায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে তৃতীয়বার মেয়র হলেন তালুকদার আব্দুল খালেক। এর আগে ২০০৮ সালে প্রথম খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির মহানগর কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির কাছে হেরে যান। এরপর ২০১৮ সালে বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ৬৫ হাজার ৬০০ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হন। এবার আবারও জয়ী হলেন।
খুলনা ও বরিশালে ভোটের চিত্র : খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট পাঁচজন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের মধ্যে নৌকা প্রতীকে তালুকদার আব্দুল খালেক পেয়েছেন এক লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আব্দুল আউয়াল (হাতপাখা) পেয়েছেন ৬০ হাজার ৬৪ ভোট।
জাতীয় পার্টির মো. শফিকুল ইসলাম মধু (লাঙ্গল) পেয়েছেন ১৮ হাজার ৭৪ ভোট। জাকের পার্টির এসএম সাব্বির হোসেন (গোলাপ ফুল) পেয়েছেন ৬০৯৬ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএম শফিকুর রহমান (টেবিল ঘড়ি) পেয়েছেন ১৭ হাজার ২১৮ ভোট। এ সিটি করপোরেশনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা দুই লাখ ৫৭ হাজার ৯৩৬ ভোট। ভোট বাতিল হয়েছে ১৬৫৯টি। বৈধ ভোটের সংখ্যা দুই লাখ ৫৬ হাজার ২৭৭টি। ভোট পড়ার হার ৪৮.১৭ শতাংশ।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তালুকদার আব্দুল খালেক এ বিজয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার অঙ্গীকার করেন। এমনকি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি তাদের সবাইকে নিয়েও কাজ করার কথা জানান।
অন্যদিকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে সাতজন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের মধ্যে নৌকা প্রতীকের আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। ইসলামী আন্দোলনের মুফতি সৈয়দ মো. ফয়জুল করীম (হাতপাখা) পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮২৮ ভোট। জাতীয় পার্টির মো. ইকবাল হোসেন তাপস (লাঙ্গল) পেয়েছেন ৬৬৬৫ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. কামরুল আহসান রুপন (টেবিল ঘড়ি) পেয়েছেন ৭৯৯৯ ভোট।
জাকের পার্টির মিজানুর রহমান বাচ্চু (গোলাপ ফুল) পেয়েছেন ২৫৪৬ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আলী হোসেন হাওলাদার (হরিণ) ২৩৮১ ও মো. আসাদুজ্জামান (হাতি) ৫২৯ ভোট পেয়েছেন। এ সিটিতে দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৯৭টি ভোটের মধ্যে পড়েছে এক লাখ ৪২ হাজার ১৭৭ ভোট। এর মধ্যে বৈধ ভোট এক লাখ ৪১ হাজার ৭৫৬টি ও বাতিল ভোট ৪২১টি। ভোট পড়ার হার ৫১.৪৬ শতাংশ।
বিকাল ৪টায় ভোট শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই আসতে শুরু করে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল। প্রথম কেন্দ্রের ফলাফলেই দেখা যায় অন্যদের তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে নৌকা। এরপর একদিকে যেমন বাড়তে থাকে ফলাফল আসা কেন্দ্রের সংখ্যা, তেমনি বাড়তে থাকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাতপাখার সঙ্গে নৌকার ভোটের ব্যবধান।
চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায় অর্ধলক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জিতেছে নৌকা। এর পরপরই নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিজয় মিছিল নিয়ে বের হয় নৌকার কর্মী-সমর্থকরা। অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে খোকন সেরনিয়াবাতের আলেকান্দার বাসভবনে। সেখানে সমবেত হয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে সবাই। নগরজুড়ে চলে মিষ্টি বিতরণ।
খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. নূরুল হক বলেন, ‘শঙ্কা-সংশয় দুটিই ছিল। শুরু থেকেই ঘরের বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রও ছিল নৌকার বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্র্যন্ত প্রমাণ হলো যে, নতুন হলেও রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ নন খোকন সেরনিয়াবাত। তার পরামর্শমতো চলেছি আমরা। প্রচার-প্রচারণা থেকে শুরু করে নির্বাচন আর ভোটযুদ্ধের কৌশল, সবই নির্ধারণ করেছেন আমাদের প্রার্থী। সবমিলিয়ে শেষ পর্র্যন্ত বিপুল ভোটে বিজয় হলো নৌকার।’
ঊষার আলো-এসএ