UsharAlo logo
শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশ-বিদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও নেতাদের কিলিং মিশন

usharalodesk
জুন ৫, ২০২৩ ১২:১৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যায় দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছে। তাদের ইন্ধন জুগিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে বিভিন্ন সময়ে পদবিধোরী অন্তত ১১ নেতা।

‘পথের কাঁটা’ টিপুকে সরাতে তারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। বিদেশ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিক অনলাইনের মাধ্যমে এতে অংশ নিয়েছেন। সর্বমোট ৩৪ জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে বাস্তবায়িত হয়েছে কিলিং মিশন।

টিপু হত্যায় শাহজাহানপুর থানার মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রাজীব আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, টিপু হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রস্তুত করে রোববার আদালতে পাঠানো হয়েছে।

মামলার সব আলামত, তথ্য-উপাত্ত, গ্রেফতারদের জবানবন্দিসহ সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র তৈরি করা হয়েছে। এর ৩৪ আসামির মধ্যে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি ১০ জন পলাতক রয়েছে।

অভিযোগপত্র ও মামলার তদন্ত সূত্র বলছে, টেন্ডারসহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মূলত আওয়ামী লীগ নেতা টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এজন্য রাজধানীর দুটি রেস্টুরেন্টে দুই দফায় বৈঠক হয়।

এতে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা যুক্ত ছিলেন। হত্যা পরিকল্পনা সফল করতে তারা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মেলান। ভিডিও কলের মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে এতে যোগ দেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিক।

পরে জিসানই শুটার মাসুমের কাছে অস্ত্র ও গুলি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ, মো. শামীম হোসাইন ওরফে মোল্লা শামীম এবং মো. মোরশেদুল আলম পলাশ ওরফে কাইল্যা পলাশ এতে সরাসরি অংশ নেন। অন্যরা তাদের অর্থ এবং তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন।

তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে বিদেশে পলাতক দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে। তারা হলেন-দুবাইয়ে পলাতক জিসান আহাম্মেদ মন্টু ওরফে এমদাদুল হক (৫০) এবং ভারতে পলাতক জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক (৪৫)। তারা যথাক্রমে এক ও দুই নং আসামি।

গ্রেফতারদের মধ্যে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে-হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়কারী সুমন সিকদার ওরফে মুসা (৪৩), টিপুর ওপর গুলি চালানো ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ (৩৭), কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া মোটরসাইকেল চালক মো. শামীম হোসাইন ওরফে মোল্লা শামীম (৩৫), ১০নং ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মতিঝিলের ‘রহস্যমানব’ হিসাবে পরিচিত মো. মারুফ রেজা সাগর (৪০), মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মো. আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ঘাতক সোহেল (৪৫)। এদের মধ্যে সাগর হত্যা পরিকল্পনার বৈঠকে ছিল। সে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য টাকা ও গুলি দেয় আরেক আসামি রাকিবের মাধ্যমে। ঘাতক সোহেলও ছিল পরিকল্পনায়।

আসামিদের মধ্যে আরও আছেন-মতিঝিলের প্রগতি সংঘের সাবেক সভাপতি (বর্তমান উপদেষ্টা) ও জাতীয় পার্টির নেতা মো. জুবের আলম খান ওরফে রবিন ওরফে রেলওয়ে রবিন (৫১), মো. হাফিজুল ইসলাম ওরফে হাফিজ (৫০), মো. তৌফিক হাসান ওরফে বাবু ওরফে বিডি বাবু (৩৬), সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. মাহবুবুর রহমান ওরফে টিটু (৪০), মো. নাসির উদ্দিন ওরফে মানিক (৪৭), মো. মশিউর রহমান ওরফে ইকরাম (৩৬)। এর মধ্যে জুবের আলম ছিল পরিকল্পনায়।

গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে আরও আছেন-ইয়াসির আরাফাত সৈকত (৩৩), আবুল হোসেন মোহাম্মদ আরফান উল্লাহ ইমাম খান ওরফে দামাল (৪৯), সেকান্দার সিকদার ওরফে আকাশ (২৬), মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. খাইরুল ইসলাম মাতবর ওরফে খোকা (৪৪), হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়কারী মুসার আপন ভাই মো. আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালে (৩৮), মো. নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির (৩৮), মতিঝিল থানার ১০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মো. ওমর ফারুক (৫২), বৃহত্তর মতিঝিল থানার ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল শাহরিয়ার (৪১), মোহাম্মদ মারুফ খান (২৮), ইসতিয়াক আহম্মেদ জিতু (৩৯), মো. ইমরান হোসেন ওরফে জিতু (৩২), মো. রাকিবুর রহমান ওরফে রাকিব (৩১), মো. মোরশেদুল আলম পলাশ ওরফে মো. মোরশেদুল হক পলাশ (৫১)।

দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ছাড়া পলাতক আরও আটজনের নাম রয়েছে অভিযোগপত্রে। তারা হলেন-এনামুল ইসলাম ওরফে এক্সেল সোহেল (৪৮), মো. রিফাত হোসেন (৩৮), কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রানা মোল্লা (৮০), মো. আমিনুল ইসলাম ওরফে হাবিব (৩৫), সামসুল হায়দার ওরফে উচ্ছল ওরফে উজ্জল (৪১), মো. কামরুজ্জামান ওরফে বাবুল ওরফে বাবুল তালুকদার (৬২), ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার (৬৮) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্য মারুফ আহমেদ মনসুর (৫৭)।

গত বছরের ২৪ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে।

সে সময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এরপর এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়। এ ঘটনায় টিপুর স্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে শাহাজাহানপুর থানায় একটি মামলা করেন।

আলোচিত এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গুলি চালানো মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেফতার করে। তার জবানবন্দিতে মূল পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদার ওরফে মুসাকে গত বছরের ৯ জুন ওমান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

এভাবে একে একে গ্রেফতার হন ২৪ জন। মুসার আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে এই কিলিং মিশনের চাঞ্চল্যকর তথ্য। যার বেশিরভাগই অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। মুসার জবানবন্দিতে আসা ১৬ জনকেই অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে।

হত্যার পরিকল্পনা : মামলার অভিযোগপত্র ও তদন্তসংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বায়তুল মোকাররমের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশে অবস্থিত ‘রুফটপ’ রেস্টুরেন্টে এ হত্যা পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়।

ওই বৈঠকে আশরাফ, মনসুর, সোহেল শাহরিয়ার, মারুফ রেজা ওরফে সাগর, মোল্লা রানা, এক্সেল সোহেল, আমিনুল ওরফে আমিনুর, বাবুল তালকুদার, রিফাত, টিটু ও খাইরুল উপস্থিত ছিল।

গোলাম আশরাফ তালুকদারের ভাই টিটুর ফোনে হত্যার সমন্বয়কারী মুসা সেখানে যায়। ওই বৈঠকে ঠিকাদারি ও স্কুলে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে কথা হয়। টিপু এসবের মধ্যস্থতা করেন এবং সঠিক হিসাব দেন না এমন কথা বলেন সোহেল শাহরিয়ার।

এছাড়া শাহজাহানপুরে সাগর ডিশের লাইন দিতে গেলে সেখানে টিপুর লোকজন তাদের মারধর করে এমন আলোচনা হয়। এভাবে সবাই তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন।

একপর্যায়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিক ও জিসানকে সেখানে ভিডিও কলে যুক্ত করা হয়। তারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। টিপুর লোকজনকে এলাকাছাড়া করার নির্দেশ দেন। টিপুকে মেরে ফেলতে হবে-আশরাফ-সাগরকে উদ্দেশ করে এমন কথা বলেন জিসান ও মানিক। বৈঠকে অংশ নেওয়া জুবের আলম খান রবিনকে দুই দিনের মধ্যে দুই লাখ টাকা ব্যবস্থার দায়িত্ব দেন সাগরকে।

তবে সোহেল শাহরিয়ার এক্সেল সোহেলকে তিন লাখ, মারুফকে পাঁচ লাখ, রবিনকে দুই লাখ, বাবুলকে তিন লাখ ও টিটুকে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করতে বলেন। এই টাকা টিপু হত্যায় ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা আরও জানান, এই বৈঠকের পর মুসাকে মোল্লা শামীম ফোন করেন। তাকে ঢাকায় আসতে বলেন। ঢাকায় ফিরে শামীমের কথার সূত্র ধরে রানা মোল্লাকে ফোন দেন মুসা।

রানার কথা অনুযায়ী তিনি রাজধানীর বেইলি রোডের ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি হাউসে যান। সেখানে সোহেল শাহরিয়ার, মোল্লা রানা, এক্সেল সোহেল, আমিনুল, শামীম ও রিফাতকে দেখতে পান।

সেখানে বসে শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিককে ফোন দেন এক্সেল সোহেল। মানিক তখন শামীমের কাছে একটি অস্ত্র আছে বলে জানায়। এরপর জিসান ইসতিয়াক জিতুর কাছ থেকে আরেকটি অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলেন।

এরপরও কিছু লাগলে ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে জানান আশরাফ ও সাগর। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, খুনটি মতিঝিল কলোনিতে না করে ওয়ার্ডের বাইরে করতে হবে। এই বৈঠকে আমিনুল ও সোহেল শাহরিয়ারকে টিপুর সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

রানা মোল্লা, উজ্জ্বল ও এক্সেল সোহেলকে নির্দেশ দেওয়া হয় মির্জা আব্বাস কলেজের আশপাশে থাকতে। আমতলা থেকে টিপুর বাসা পর্যন্ত নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয় রিফাতকে। শামীমকে মোটরসাইকেল কেনাসহ খরচ চালাতে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়।

রানা মোল্লা, আমিনুল ও রিফাতকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সবাই চলে যান। পরে জিসানের নির্দেশনা অনুযায়ী টিপু হত্যার জন্য সাগরের কাছ থেকে ১৫টি গুলি সংগ্রহ করা হয়। এরপর সম্পন্ন হয় কিলিং মিশন।

ঊষার আলো-এসএ