উষার আলো প্রতিবেদক : “মা বাইরে যাবো টাকা দাও, টাকা না দিলে তোমাকে ছাড়বোই না! জলদি নাস্তা দেও, নাস্তা খেয়ে বাইরে যাবে, হাতে অনেক কাজ, তাড়াতাড়ি করো মা, আামি ব্যস্ত। কখনো আবার ফোনে বন্ধুরা মিলে পিকনিক করবো, আসতে একটু দেরি হবে মা, চিন্তা করো না। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখনও আমি জেগে বসে আছি ছেলের অপেক্ষায়, ছেলে ঘরে ফেরার পর তারপর আমার চোখে ঘুম আসবে। ছেলেকে আদর করে ডাকতাম তাসিম বলে। ওর পৃথিবীতে যেন আমি ছাড়া আর কেউ নেই, সারাক্ষন মা, মা করে অস্থির করে তুলতো গোটা বাড়ীটাকে। ছেলের সকল অবদারের আভাসস্থল যেন আমি। যে আবদারই হোক না কেন বাবাকে বলবেনা, আমাকেই বলবে।
“তোর কোন আবদার আমি অপূরণ রেখেছি রে তাসিম, কেন তুই এভাবে আমাকে রেখে চলে গেলিরে বাবা, তোর মা তোকে ছাড়া এখন কেমন করে বাঁচবে? আমাকে একা ফেলে এভাবে চলো গেলি রে বাবা, এখন খাবার সামনে নিয়ে তোর অপেক্ষায় কে রাত জেগে বসে থাকবে, কে চাইবে টাকা! মা আমি মোটরসাইকেলে তেল ভরবো টাকা দাও” এমন আর্তনাত আর অশ্রুসিক্ত নয়নে কথা গুলো শোনা গেল আজ শনিবার (২ জুন) সন্ধ্যায় একমাত্র ছোট ছেলে কলেজ ছাত্র সৈয়দ তাহমিদুন্নবী তাসিবের মায়ের মুখে। একমাত্র নাড়ি চেড়া ধন ছেলে তাসিমকে হারিয়ে তিনি যেন শোকে নিথর আর পাগল প্রায়।
তিনি জানান, আমার স্বামী একজন ব্যবসায়ী এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে আমার সুখের সংসার। তাসিম ছিল অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদামাঠা মনের মানুষ, ছিল পরোপকারী। কারো বিপদ দেখে দাড়িয়ে থাকিনি। আজ আমার ছেলের সাথে এ কি ঘটলো। আমার ছেলে এমনকি অপরাধ করলো যে ওকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। একটি মায়ের বুককে খালি করে দেওয়া হলো। আমার ছেলে এমন কোনো অপরাধ দেখছিনা যে ওকে নিষ্ঠুর অমানুষের মতো মারতে হলো, এর পেছনে অন্য কোনো ইন্দন বা পরিকল্পনা করছে বলে আমার ধারনা। যারা আমার ছেলেকে নিশৃংসভাবে ভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তারা কারো ইন্দরে এমন কাজ করেছে বলে আমার ধারনা। আমি পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমার ছেলে খুনিদের গ্রেফতার ও এই ঘটনায় জড়িদের দেশের প্রচলিত আইনে সর্ব্বোচ শাস্তির দাবি জানাই। যে শাস্তি দেখে এমন অপরাধ করার আগে অপরাধীেেদর বুক কেপে উঠবে।
নিহত তাহমিদুলের বড়বোন জানান, আমরা দুই ভাই বোন মানিক জোড়ার মতো। বাবা মায়ের কাছে আমরা অতি আদরের। তবে আমার ভাই পরিবারের সকলে খুবই ভালো ভাসতো। তাহমিদ ছিল সকলের নয়নের মনি। ভাইয়ের সাথে কত জানা অজানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যা আজ সবই অতিত। কত অভিমান, কত হাসি-ঠাট্টা করছি। এখন তাহমিদ বাসায় ঢুকে আমার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সারাদিনই দুষ্টুমি করতো, ভাগ্নেকে সারাক্ষণ ঘাড়ের উপর রাখতো, খুবই আদর করতো তাকে। বাইরে হতে এসেই আগে ভাগ্নেকে বুকে জড়িয়ে ধরতো। আমার ভাই কি অপরাধ করেছে যে এমন নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করা হলো। খুনিরা ভাইয়ের হাত পা ভেঙে ফেললেও ভাইকে দেখতে পেতাম। আজ তার জীবনটা কেড়ে নেওয়া হলো। আমি আমরা ভাইয়ের খুনিদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি জানায়।
নিহত তাহমিদের খালা স্কুল শিক্ষক জানান, দেশে আজ চরম সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। মানুষ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসতে চাইনা। যখন তাহমিদকে দুর্বৃত্তরা হামলা করে তখন অনেকেই দাড়িয়ে দেখেছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। সবখানে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তার করেছে, যার কারনে প্রতিদিনই কোনো কোনো জায়গায় এই গ্যাংয়ের মাধ্যমে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। আজ তেমনি তাহমিদের জীবন ঝড়ে পড়লো। এমন ঘটনায় যেন আর কারো স্বজন না হারাতে হয়, কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। প্রশাসনের প্রতি আহবান এ ঘটনার সুস্থ তদন্ত করে খুনিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করার।
একই এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম অপু জানান, তাহমিদুল খুব ভালো ছেলে ছিল। সকলের সাথে হাসি খুশি ভাবে চলতো। সে একটি বন্ধু প্রিয় মানুষ ছিল। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে সব সময় চলাফেরা করতে। এমন কোনো অপরাধ তাকে করতে দেখিনি যে এমন নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করতে হবে। পাবলা সর্বস্তরের মানুষ প্রশাসনের কাছে এমন নির্মম হত্যাকান্ডের সুষ্ঠ বিচার দাবি করছে।
উল্লেখ্য, ৩০ জুন (বৃহস্পতিবার) দুপুরে দৌলতপুরস্থ পাবলা সাহাপাড়া এলাকার মোঃ পলাশ মোল্লার দোকানের ফার্নিচারের মেশিন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দোকান মালিক মোঃ পলাশ মোল্লা ও মোঃ পিয়াল মোল্লার সাথে তাহমিদুলের কথা কাটাকাটির এই পর্যায়ে আসামীদ্বয় ভিকটিম তাহমিদুলকে ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে। এতে তাহমিদুল মারাত্বক জখম হয়। অতঃপর গুরুতর জখম অবস্থায় ভিকটিককে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে খুমেক হাসপাতালে নিয়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওই ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে পৌছে পিয়াল মোল্লা (২২) কে গ্রেফতার করে। গত ১ জুলাই (শুক্রবার) বেলা ১২ টার দিকে খুমেক হাসপাতালে কলেজ ছাত্র তাহমিদুন্নবী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
কলেজ ছাত্র তাহমিদুন্নবীর হত্যার ঘটনায় ভিকটিমের তৌহিদুন্নবী গত ১ জুলাই (শুক্রবার) দুপুরে দেয়ানা পাখির মোড়ের নুর মোহাম্মাদ ইমামের বাড়ীর ভাড়াটিয়া মৃতঃ আজিজ মোল্লার পুত্র মোঃ পলাশ মোল্লা (৪০) ও একই এলাকার বাসিন্দা আসমার বাড়ীর ভাড়াটিয়া নাসির মোঃ নাসির মোল্লার পুত্র মোঃ পিয়াল মোল্লা (২২) এর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মিজানুর রহমান জানান, কলেজ ছাত্র তাহমিদুন্নবী হত্যা কান্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় দুই এজাহার নামীয় আসামীর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ভিকটিমের উপর হামলার দিনই বর্তমান এজহার নামীয় আসামী পিয়ালকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বিজ্ঞ আলাদতেও প্রেরণ করা হয়েছে। অপর আসামী মোঃ পলাশ মোল্লাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে অভিযান চলছে। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।