UsharAlo logo
বুধবার, ১২ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী তুমি বিপ্লবী : তুমিও পাড়ো

সাংবাদিক মহেন্দ্রনাথ সেন
মার্চ ১১, ২০২৫ ৭:৩৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

  লেখক : সাংবাদিক মহেন্দ্রনাথ সেন

যখন দেশে কোন সংকট এসেছে, তখনই তুমি দাঁড়িয়েছ বিপ্লবী বেশে। তুমি না প্রীতিলতা, কল্পনা, ইলা মিত্র, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালের অনুসারি। তবে ভয় কেন? সমাজ, সংসার কর্মক্ষেত্রে সবখানেই তুমি। বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভেঙ্গে চোখের উপর চোখ রেখে দাঁড়িয়েছ রাষ্ট্রের অনিয়ম ভাঙ্গতে।
বিট্রিশ আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ , স্বৈরাচার আন্দোলন, চব্বিশের আন্দোলন সবখানে তুমি নারী ছিলে নেতৃত্বে। রাজপথে কাঁপিয়ে দিয়েছো শ্লোগানে। রাজপথে তোমার ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহখানি ওড়নায় মুড়িয়ে নিয়ে গেছো হাসপাতালের বাড়ান্দায়। রাতের পর রাত জেগে ছিলে আহত যোদ্ধার পাশে। লিঙ্গ বৈষম্যের কথা তুমিতো কখনও ভাবোনি। রাষ্ট্র আর সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছো তুমি বিপ্লবী।
তোমাদের সরলতায় সমাজে উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণ আজও অব্যাহত রয়েছে। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনপরিসরে নারীরা প্রায়ই বৈষম্য ও নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক নির্যাতন মাঝে মাঝে রাষ্ট্র, সরকারকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য তোমাকেই লড়তে হবে। অধিকার আদায় করে নিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। বুঝিয়ে দিতে হবে তুমি কারো জায়া, কারো জননী আবার কারো ¯েœহের কন্যা। তুমি বহুমুখী। তোমার এক একটি অধ্যায়, এক একটি চরিত্র।
সমাজের একটি বড় অংশ তোমাকে দুর্বল হিসেবে দেখে এবং তাঁর অধিকার ও মর্যাদাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে না। এই সমস্যা শুধু শহরেই নয়, গ্রামীণ এলাকাতেও বিদ্যমান, তোমরা অনেক সময় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছো।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই সময়কালে দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার ৪৭৯টি, যার মানে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। একই সময়ে দেশে ৫৯ হাজার ৯৬০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রাকে প্রকাশ করে না, বরং সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থার অক্ষমতা এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে। ২০২৪ সালে যৌতুকের দাবিতে ৩৬ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন, যা সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয়।
দেশে কন্যাশিশুরাও নিরাপদ নয়। ২০২৪ সালে ২২৪টি কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, যদিও অনেকেই মনে করেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ, অধিকাংশ সময় শিশুরা এ ধরনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে ভয় পায়। একই বছরে ধর্ষণের পর ৮১টি কন্যাশিশুর হত্যার ঘটনা ঘটে এবং ১৩৩টি কন্যাশিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরছে। তাঁরা পারিবারিক নির্যাতনের পাশাপাশি বাইওে বের হলেও ধর্ষণ ও সহিংসতার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন এবং বিশেষ করে ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকেরা আইনের দুর্বলতার কারণে পার পেয়ে যায়, যা তাদের আরও অপরাধে জড়াতে উৎসাহিত করেছে।
গবেষণা অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পযন্ত বাংলাদেশে ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৫টি মামলায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এই পরিসংখ্যানই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে ধর্ষণের বিচারব্যবস্থা কতটা দুর্বল এবং অপরাধীরা কীভাবে পার পেয়ে যায়।
বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি ধর্ষকদের দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বিচারহীনতার কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে।
তোমাকেই সেখানে কাজ করতে হবে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি ভেঙ্গে ধর্ষিতা নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। ধর্ষক যে হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, ধর্ষক যদি তোমার স্বামী, পুত্র সন্তান কিংবা আপন ভাই হয় তাকেও আইনের হাতে তুলে দিতে হবে। আইন অনেক হয়েছে। তার যথার্থ প্রয়োগ আজও হয়নি। স্বাক্ষী আর প্রমাণে ভয়ে সব শেষ হয়ে গেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বলে তোমাকে দাবিয়ে রাখতে চায়। সম্পদে দিতে চায়না অধিকার। চিন্তায় মননে তুমিই তোমাকে পিছিয়ে দিচ্ছো।
আর কথা নয়, নামতে হবে তোমার স্বার্থে রাজপথে । তোমার অধিকার তোমাকে বুঝে নিতে হবে। আছিয়াদের কাছে ঋণী হলে চলবে না। আছিয়ার স্বজনদের পাশে তোমাকেই দাঁড়াতে হবে। কোনভাবে যেন আছিয়ার স্বজনরা বিষয়টি ভিন্নখাতে না নিতে পাড়ে তাঁরজন্য চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখতে হবে তুমি বিপ্লবী প্রীতিলতা, কল্পনা, ইলা মিত্র, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালের অনুসারি।
শেষ করতে চাই ১৯০৪ সালের বেগম রোকেয়ার সেই লেখা দিয়ে- পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীমাজিস্ট্রেট, লেডীব্যারিস্টার, লেডীজজ – সবই হইব!… উপার্জ্জন করিব না কেন?… যে পরিশ্রম আমরা “স্বামী”র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?… আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে। এখন অনুশীলন দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব। যে বাহুলতা পরিশ্রম না করায় হীনবল হইয়াছে, তাহাকে খাটাইয়া সবল করিলে হয় না?
বেগম রোকায়ার সাথে তাল মিলিয়ে বলবো জাগো নারী-জাগাও বিবেক। এগিয়ে যাও, তোমরা বিপ্লবী, তোমরাই পাড়বে। তোমরা সজাগ থাকলে আছিয়াদের ধর্ষণের বিচার দ্রæত বিচার ট্রাইবুন্যালেই হবে। তবে দেখতে হবে কোনভাবেই যেন ধর্ষকরা আইনের ফাঁক থেকে বের হতে না পারে।

ঊআ-বিএস