UsharAlo logo
শুক্রবার, ২০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দেশে দেশে নারী শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা !

pial
মে ১৪, ২০২২ ৫:৫৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সোহেল সানি : অতিপ্রাচীনকালে পুরুষ নারীকে দেবীর মর্যাদা দিয়েছে । নারীর মূর্তি বানিয়ে পুজা করেছে। নারীকে ভাগ্য বিধার্থীর অবস্থানে কল্পনা করে। আবার ধর্মে মনোনিবেশ করে সেটাকে অস্বীকার করেছে। প্রতিষ্ঠা করেছে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।

ইহুদী ধর্মে নারীকে সমস্ত পাপের মূল কারণ বলে মনে করে। তারা পুরুষকে পুরোহিতের অধিকার দিয়ে নারীকে সেবিকার মানে দেখে।
ইহুদী আইনে পুরুষ উত্তরাধিকারীর বর্তমানে নারী উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতো। ইহুদী ধর্মে পুরুষের বহুবিবাহ একটি অতি সাধারণ ব্যপার মাত্র। সেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদেও নারী হিলারী ক্লিনটনকে প্রার্থী করে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। ১৯১৮ সালে আমেরিকায় নারীরা ভোটাধিকার পেলেও সমাজ, রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পায় ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আমলে। হিলারী ক্লিনটন তাঁর স্ত্রী।

খ্রীষ্টান ধর্মে নারীর মর্যাদাকে অতি নীচুস্তরে দেখানো হয়েছে। খ্রীষ্টান পাদ্রীর মতে নারীই (হাওয়া) পুরুষকে (আদম) পাপের পথে নিয়ে গেছে।

খ্রীষ্টান সাহিত্যেও নারীকে ঘৃণা ও তিরস্কারের চোখে দেখা হয়। সেই ব্রিটিশ রাজত্বেও নারী মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাস রচনা করেন।

অহিংস ধর্ম বলে যার প্রচার সেই বৌদ্ধ ধর্মেও নারীর মর্যাদা অতি নগণ্য। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও নারীর অধিকার শর্তসাপেক্ষ। পিতা অবলীলায় নিজের সন্তান বিক্রি করে দিতে পারতেন। নারীর কোন স্বাধীন সত্তাই কল্পনা করা শাস্তিজনক অপরাধ বলে গণ্য হতো।

ভারতের হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান অত্যন্ত করুন। হিন্দু নারী কখনও দাসত্ব ও পরাধীনতার জীবন থেকে মুক্ত হতে পারেনি সেই যুগে। মনু সংহিতার মাধ্যমে হিন্দু নারীর হীন অবস্থান গ্লানীপূর্ণ করা। মনু সংহিতা মূলতঃ কতিপয় পন্ডিত ভাববিশ্বাসের রচনা সংকলন মাত্র। এ হিন্দু আইনের জনক মনুর নাম অনুসারে একে বলা হয় ” মনু সংহিতা”। খ্রীষ্টপূর্ব ও পরবর্তী দুই শত বছরের মধ্যে মনুর এই আইন গ্রন্থ পূর্ণতালাভ করে এবং তা প্রথম ও দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে হিন্দু ধর্মের মূল আইনগত ভিত্তি হয়ে ওঠে। মনু বাল্যবিবাহ আইন করেন এবং বরপক্ষ কর্তৃক কনের পিতাকে দেয়া শুল্কপ্রথা বিলুপ্ত করেন।

অর্থাৎ উল্টো বরপক্ষ কনের পিতাকে শুল্ক (বরপণ) প্রথা প্রচলন করেন। বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করে সতীদাহ প্রথা উদ্ভব ঘটিয়ে বর স্বামী মারা গেলে স্তী হিসাবে কনে নারীকে জ্যন্ত চিতায় নিক্ষেপ করা হতো। ব্রাক্ষ্মনরা ধর্ম ব্যাখ্যায় কঠিন বিধি আরোপ করে করে নারীর কঠোর অবরোধ প্রথা সতীদাহ, নারীর উত্তরাধিকারহীনতা, পুরুষের বহুগামীতা ও বিধবা নারীর বিবাহ রোধ নারীকে নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্টকারী কুপ্রথার প্রচলন করেন। মধ্যযুগে বাংলার আইনবিশারথ জীমুত বাহন সর্বপ্রথম হিন্দু নারীকে সম্পত্তির নুন্যতম কিছু অংশ দেয়ার কন্য দুটি উদারনীতি গ্রহণ করেন। পতি অন্য পত্নী গ্রহণ করলে পূর্ব পত্নীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য ও পুত্র সন্তান আগের পত্নীর গর্ভজাত হলে বিবাহিত পতি সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ ওপর অধিকার থাকবে কন্যার বা কনের।

নির্মম সত্য নারীর এ সামান্য অধিকারও বাঙালী পুরুষতন্ত্র স্বীকার করেনি। জীমত বাহনের নীতির বাস্তবায়ণ বাধ্যতামূলক হওয়ায় বাংলার সমাজপতিরা স্বামীর মারা গেলে বিধবা পত্নীর কাছে হাজির হয়ে দুইটি প্রস্তাব করতো- হয় মৃত পতির সঙ্গে জ্যান্ত সহমরণে রাজী হতে হবে নয়তো সম্পত্তির অধিকার পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে হবে, তা নাহলে তার সন্তানদেরও সম্পত্তির প্রতি কোন অধিকার থাকবে না।

অসহায় সন্তানদের মাতৃত্বের বন্ধন কোন মা কি অস্বীকার করতে পারে? অতএব বিধবা মা মৃত পতির সঙ্গে জলন্ত চিতায় উপবিষ্ট হয়ে সহমরণে রাজী হয়ে প্রাণ সংহার করে সম্তানের মূল্য দিয়ে পতির দায় শোধ করতো। ফলে সন্তানের সঙ্গে মাতৃত্বের নারীর বাঁধন ছিন্ন না করে বাংলার সতীদাহের হার বেড়েই চলছিল। রাজা রাম মোহন ও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো গুণী মনীষীদের কারণে সেই প্রথার অবসান হয়। ভারতে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হয়ে এবং সর্বশেষ সুষমা পাতিল রাষ্ট্রপতি হয়ে নারীর মর্যাদাকে পুরুষের সম করে তোলেন।
প্রাক ইসলামী যুগে আরবেরা নারীকে নির্যাতন করতো এমনভাবে যা কোন লেখক সাংবাদিকের বর্ননাতীত। সন্তানকে পুড়িয়ে মারা, জীবন্ত কবর দেয়া, ঘোড়ার লেজে বেঁধে টেনেহেঁচড়ে পাশবিক অত্যাচার ছিল তাদের দৈনন্দিন উৎসবের আনন্দকর ফূর্তি বিশেষ। পবিত্র ইসলাম নিয়ে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) নারীকে সম্মান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করে বলেন, ইসলামে নারী -পুরুষের সমান সম মর্যাদা এবং নারীর জন্য অভিন্ন আইন প্রণীত হয়েছে। নারীদের অধিকার পবিত্র তাতে হস্তক্ষেপ করো না। নারী (পত্নী) পুরুষের (পতির) পরিচ্ছদ ও পুরুষ (পতি) নারীর (পত্নী) পরিচ্ছদ (আল বাকারাঃ১৮৭), পত্নীর তেমনি ন্যয় সঙ্গত অধিকার আছে, স্বামীদের ওপর যেমন আছে স্বামীদের ওপর পত্নীর ওপর(আল বাকারাঃ২২৮), তোমরা পরসপরের প্রতি উদারতা করতে ভুলিও না।” (আল বাকারাঃ২৩৭) ।

বংশানুক্রমিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার ও সমাজ নিয়ন্ত্রনে নারীর ভুমিকাই ছিল প্রধান।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিবার ও সমাজের নেতৃত্ব উঠে আসে পুরুষের হাতে। অসভ্য যুগ থেকে বর্বর যুগের সূচনা হলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা গৌষ্ঠিসমাজ জননী বিধির পরিবর্তে ‘জনক’ বিধির প্রয়োগে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজব্যবস্থা প্রচলন শুরু হয়। অর্থাৎ ‘ মাতৃতন্ত্র’ এর পরিবর্তে ‘পিতৃতন্ত্র’ কায়েম হওয়ায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক,সামাজিক বলয়ে নারীর নুন্যতম অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলার অনার্য সমাজ পরিচালিত হতো মাতৃতান্ত্রিক কাঠামোয়ে সম্পূর্ণভাবে ‘জননী’ বিধি অনুসরণ করে। আর্য আগমনে নারীর সর্বময় কর্তৃত্ব ভেঙ্গে যায়।

সমাজের কর্তৃত্ব চলে আসে পুরুষের হাতের মুঠোয়। আদিম যুগে অবসানের পর ভারত উপমহাদেশে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আবির্ভাব হলে নারীর অবস্থান আরও নীচে নেমে যায়। ‘জনক’ বিধি নারীকে গৃহকোণে আবদ্ধ করে। শিক্ষা,শিল্প সংস্কৃতি,সংগীত প্রভূত বিকাশ ঘটলেও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অথচ, সেই সামন্ত যুগে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা ইউরোপে সভ্যতা বিকাশে অবদান রাখে। প্রাচীন এ্যাথেনীয় গ্রীক দর্শনে নারী সম্পর্কে বলা আছে যে, আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীকরা নারীর বিষয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে তা সর্বক্ষেত্রে নারীর বিকাশে বিঘ্নতার সৃষ্টি করে।
গ্রীক মূল্যবোধ নারী-পুরুষের ভুমিকায় নারীর ভুমিকা নেতিবাচক।

(ঊষার আলো-এফএসপি)