UsharAlo logo
শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

প্রতিষ্ঠিত হোক সকল শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা

usharalodesk
অক্টোবর ১৬, ২০২১ ৫:২৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

মোঃ আলমগীর হোসেন

ঊষার আলো ডেস্ক : শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। তারাই আগামী দিনে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবে। জ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে সকলের জন্য কল্যাণকর নতুন বিশ্ব। তাই শিশুদের প্রতি আমাদের বিশেষভাবে যত্ন নেয়া উচিৎ। তারা যেন সৃজনশীল, মননশীল এবং মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের। বর্তমানে বিশ্বে মোট শিশুর সংখ্যা প্রায় দুইশত বিশ কোটি। এই শিশুদের অর্ধেকের বেশি কোভিড মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ও সত্তর লাখ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার হয়েছে। শিশু শ্রমে জড়িত হয়েছে এক কোটি ষাট লাখ শিশু । কোভিড-১৯ মহামারি ছাড়াও বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময়ে শিশুরা যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগের শিকার হয়ে তাদের অধিকার ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশে শিশুদের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শিশুদের জন্য সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দিবে। দেশ স্বাধীনের পূর্বে ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আউয়ুব খান জোর করেই দেশের ক্ষমতা দখল করে শেখ মুজিবসহ বহু নেতাকর্মীকে জেলে আটকে রাখেন। পাঁচবছরের জন্য পুরো দেশের রাজনীতি বন্ধ করার নির্দেশ দেন। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে জাতির পিতা কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘এই পাঁচ বছর তোমরা শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে কাজ করো। নিজেদের সচল রাখো।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৬৩ সালে ঢাকার প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে কঁচি-কাঁচার মেলা আয়োজিত শিশু আনন্দমেলায় এসে বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য’। শিশুদের সান্নিধ্যে জাতির পিতার এই অনুভূতি থেকে উপলব্ধি করা যায় শিশুদের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার গভীরতা। সরকারি ও দলীয়কাজে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্ন সফরে যেতেন তখন চলার পথে কোনো শিশু দেখলে গাড়ি থামিয়ে সেইসব শিশুর সাথে গল্প করতেন ও খোঁজখবর নিতেন। দুঃস্থ ও অসহায় শিশুদের পরম মমতায় কাছে টেনে নিতেন। কখনো কখনো নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিজের বাড়িতে বা অফিসে নিয়ে যেতেন। কাপড় ও খেলনাসহ বিভিন্ন উপহার দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতেন।
আজ থেকে উনসত্তর বছর পূর্বে ১৯৫২ সালে চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেই শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। শিশুদের উন্নয়নে চীন সরকারের গৃহীত কার্যক্রম ও সে দেশের শিশুদের উন্নয়ন কাছ থেকে দেখেছেন। জাতির পিতার সেই ভ্রমণ ভাবনার মধ্যেও ছিল তার স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলা। দেশের শিশুদের কীভাবে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেসব ভাবনাও তিনি সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন “আমার দেখা নয়া চীন” বইটিতে। তিনি স্কুল পরিদর্শনে যেয়ে অভিজ্ঞতায় লিখেছেন, “ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন। তার সাথে একঘন্টা আলাপ হলো। তিনি আমাকে বললেন, বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছি। প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হয়। সরকার তাদের যাবতীয় খরচ বহন করে”। (“আমার দেখা নয়া চীন”, পৃষ্ঠা ৬০)। চীনের নতুন ভবন, স্কুল নির্মাণ ও স্কুল শিশুদের দেখে জাতির পিতা তাঁর ভ্রমণ কথায় লিখেছেন, “…শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি দেখে ফিরে এলাম। খাওয়াপরা পেয়ে নয়াচীনের ছেলেমেয়েদের চেহারা খুলে গিয়েছে। মুখেতাদের হাসি, বুকে তাদের বল, ভবিষ্যতের চিন্তা নাই। মনের আনন্দে তারা খেলছে। (“আমার দেখা নয়া চীন”, পৃষ্ঠা ৬০)।
দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা শিক্ষার উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন দেশের শিশুদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সকল শিশু যাতে শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে সেজন্য একসাথে লক্ষাধিক শিক্ষকের চাকুরিসহ ছত্রিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করেন। সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। একইসাথে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংস ও বিধ্বস্ত স্কুলগুলো নতুনভাবে তৈরি ও সংস্কার করেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করে ১৯৮৯ সালে যার ১৫ বছর পূর্বে জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেন।
জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শিশুদের নিরাপদে বেড়ে ওঠা, সুষম বিকাশ ও সুরক্ষার বিষয় গুরুত্বের সাথে বিভিন্ন আইন, নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। একসাথে ছাব্বিশ হাজার স্কুল ও এক লাখ বিশ হাজার শিক্ষকের চাকুরি জাতীয়করণ করেছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন করছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডজিতে শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জনে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মায়ের গর্ভাবস্থা থেকে ৩ বছর পর্যন্ত মা ও শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি চালু আছে। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য দূর করা এবং তাদের শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী রূপে গড়ে তুলতে ছাত্রী উপবৃত্তি প্রদানসহ নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই ও শিক্ষা উপকরণ তুলে দেওয়া হচ্ছে।দেশের বিদ্যালয়সমূহে নতুন আকর্ষণীয় ভবন নির্মাণ করছেন। ছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পৃথক ওয়াশ রুম করা হয়েছে।স্কুলগুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব উদ্যোগের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, যা একদশক আগে ছিল মাত্র ৬১ শতাংশ। এর ফলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার হার বেড়েছে বহুগুণ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক যুগ সরকার পরিচালনাকালে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী বিভিন্ন আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন। যা দেশে শিশুদের উন্নয়ন ও বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩, শিশু আইন ২০১৩, যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮, ডিএনএ আইন ২০১৪, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আইন ২০১৮ ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০২০,শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন ২০২১ ও বাল্যবিয়ে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮ ২০৩০ প্রণয়ন করেছেন। কন্যা শিশুরনারী শিক্ষার প্রসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক পিস ট্রি পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৯ সালের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার স্বীকৃতি স্বরূপ গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিরো পুরস্কার প্রদান করে। এ বছর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তিনি এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মাননীয় প্রধামন্ত্রী শিশুদের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এসব অর্জনতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অর্থনীতির সকল সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যমোচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য দরকার শিশুদের উন্নয়নে বিনিয়োগ। শিশুদের উপর বিনিয়োগ করলে তার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে দেশ ও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন প্রত্যেক শিশুর অন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ ও তা নিশ্চিত করা। সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এ শিশুদের উন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য যেসব অভিষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জনে কাজ চলমান রয়েছে। বঙবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে একটা উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার এই পরিক্রমায় সরকার শিশুদের ওপর কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ করছে। এই লক্ষ্যে সরকারের পনেরটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আশি হাজার কোটি টাকার শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়ন করছে। এই শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার আগামী প্রজন্মকে মেধাবী ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশুর উন্নয়ন, সুরক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসহ শিশুর সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশু বিকাশ কেন্দ্র, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, প্রারম্ভিক মেধাবিকাশ কার্যক্রম, আবৃত্তি, সংগীত, চিত্রাঙ্কন ও নৃত্যসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। যার ফলে আমাদের শিশুরা দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অসামান্য সাফল্য অর্জন করছে। গত দেড় বছরে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আমাদের শিশুরা ছিল ঘরবন্দি। তবে এই মহামারিতেও শিশুরা তাদের পড়াশোনা থেকে দূরে ছিলনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে গ্রামের শিশু শিক্ষার্থীটিও কোভিড-১৯ দুঃসময়ে ঘরে বসে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা কোভিড-১৯ মহামারি অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন শিশুদের পদচারণায় মুখরিত শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষার আলোয় বিকশিত হোক তাদের জীবন। সকল শিশুর জীবন হোক সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও নিরাপদ।

(ঊষার আলো-এফএসপি)