সরকারের ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ প্রতিবন্ধকতার বৃত্তে আটকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ। যে কারণে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, বিনিয়োগও বাড়েনি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বাধা শনাক্ত করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘পালটা শুল্ক’ আরোপ মোকাবিলায় এসব নীতিগত বাধা দূর করতে কাজ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এছাড়া ইউনাইটেড স্টেটস অব ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) অফিসের সঙ্গে বুধবার রাতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন অনলাইনে বৈঠক করেছেন। বাণিজ্য বাড়াতে সব ধরনের সহায়তার বিষয় ওই বৈঠকে তুলে ধরেন তিনি। পাশাপাশি শুল্ক ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে ইউএসটিআরের সঙ্গে দূতাবাসও কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ইতোমধ্যে পোশাক খাতের বেশ কিছু অর্ডার বাতিল হয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আরও অর্ডার বাতিল করতে পারেন এমন শঙ্কাও উদ্যোক্তাদের ভেতর কাজ করছে। রপ্তানির উদ্দেশ্যে অনেক পণ্যের গায়ে মূল্যের ট্যাগ লাগানোর কাজও শেষ। ফলে পুরনো মূল্যে এসব পণ্য রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বুধবার বিকালে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। একটি দেশ শুল্ক নিয়ে নিজস্ব নীতি প্রণয়ন করতে পারে। তবে আমরা সব জায়গা থেকে কাজ করছি। আজ (বুধবার রাতে) ইউনাইটেড স্টেটস অব ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) অফিসের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করব। সেখানে সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হবে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা ও সয়াবিনসহ কৃষিপণ্য আমদানি করছি। এজন্য দেশটির কৃষিভিত্তিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। আজ (বুধবার) সকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, এটি সমাধানের জন্য আমরা সর্বোত্তম চেষ্টা করছি। এছাড়া টিকফাতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে সাবেক বাণিজ্য সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ জানান, ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টি সমাধানের অফিশিয়াল ফোরাম হচ্ছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা)। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই সময় বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে আমি স্বাক্ষর করেছিলাম। টিকফা চুক্তিতে একটি বিধানে বলা আছে উভয় দেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত কোনো জটিল সমস্যার মুখে পড়লে সেটি সমাধানের লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে টিকফা ফোরামের বৈঠক আহ্বান করা যাবে। বাংলাদেশ চাইলে এখন জরুরি ভিত্তিতে টিকফার বৈঠক ডেকে সেখানে শুল্ক আরোপের বিষয়টি আলোচনা করতে পারে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ অনেক পণ্যে শুল্ক জিরো করে দিচ্ছে, এটি ঠিক হবে না। এর উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলাসহ কয়েকটি পণ্যে শূন্য শুল্ক আছে। এরপরও তুলা আমদানি বাড়েনি। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে মার্কিন পণ্যের মূল্য ও আমদানি ব্যয়। ফলে পণ্যে শূন্য শুল্ক আরোপ করলেই আমদানি বাড়বে না। তবে অন্তবর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি ঠিক আছে।
সূত্রমতে, ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপ মোকাবিলায় সরকার কয়েকটি পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো। এ নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কাজ করতে গিয়ে দেখেছে বিগত সময়ে দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ না হওয়ার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকা ছিল। সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রাক্তন নাগরিক, দ্বৈত নাগরিকত্বধারী বা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে অভিবাসিত ব্যক্তি আছেন যারা বাংলাদেশে অর্জিত বৈধ সম্পদ তরল করে যুক্তরাষ্ট্রে নিতে পারেন না, তাদের নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক বাধার কারণে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এমন ব্যক্তিরা প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ডধারী, প্রাক্তন বাংলাদেশি নাগরিক (বর্তমানে মার্কিন নাগরিক) যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত দ্বৈত নাগরিকত্বধারী বাংলাদেশি এবং এসব ব্যক্তির সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে তাদের অর্জিত বৈধ, কর-পরিশোধিত ও ঘোষিত সম্পদ ও আয় তরল করে মার্কিন ডলারে যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সরকারি এক কর্মকর্তা জানান, অভিবাসীরা তাদের সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে পারলে, তারা আরও সম্পদ সৃষ্টি করতে পারবেন এবং সেটি বাংলাদেশে পাঠাতে পারবেন।
এছাড়া আরও একটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার বিধান নেই। এখানে মোট আয়ের ৫ শতাংশ পুনর্বিনিয়োগের সুবিধা রাখা যেতে পারে। এটি প্রথম এলে প্রথম পায় বা কোটা ভিত্তিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের জন্য এফডিআই সুবিধা হিসাবে দেওয়া যেতে পারে। এই বিনিয়োগের লাভ বাংলাদেশে ফেরত আসতে হবে এফডিআই আকারে। অবশ্য এসব বিষয় ইঙ্গিত দিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাগুলো, শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো কী এবং ব্যবসা করতে গিয়ে যেসব জায়গায় তাদের সমস্যা হচ্ছে সেগুলো শনাক্ত করা হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির জন্য যেগুলো সহায়ক, সেগুলো তো আমরা করব। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। প্রসঙ্গ গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
সরকারের হিসাবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮.৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) মার্কিন ডলারের পণ্য। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ২.২ বিলিয়ন (২২০ কোটি) ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট আমদানির ৭৫ শতাংশ হচ্ছে তুলা, লোহার স্ক্র্যাপ, সয়াবিন এবং জ্বালানি পণ্য। এছাড়া বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৬ বিলিয?ন (৬০০ কোটি) ডলার রেমিট্যান্স পাচ্ছে যা মোট রেমিট্যান্সের ৩০ শতাংশ। অপরদিকে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৬ মিলিয়ন (৬০ লাখ) ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। আরও জানা গেছে, বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ প্রাায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার, আর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বিনিয়োগ মাত্র ১৭ মিলিয়ন ডলার। এ প্রসঙ্গে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স অব বাংলাদেশ (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ জানান, সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতিকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। আমি বিশ্বাস করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে, তবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তা সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেন, বাস্তবে বাংলাদেশে অনেক ভালো আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। তিনি আরও বলেন, দেশে আন্তর্জাতিক নিবন্ধন পরিকল্পনা (আইআরপি) বিধিমালায় দুর্বলতা আছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য একাধিক মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় এবং মনোযোগ প্রয়োজন। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য এ দেশে নকল করে ফেলতে পারে। সে শঙ্কা থেকেও এখানে রপ্তানি করতে চায় না সে দেশের উদ্যোক্তারা। এছাড়া বন্দর ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি আমেরিকা থেকে সরকারি কেনাকাটা বাড়াতে হবে।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক মোকাবিলায় বাংলাদেশ বাণিজ্য বাড়ানোর দিকে পুরোপুরি নজর দিচ্ছে। বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় বর্তমানে ১৯০টি পণ্যের ওপর শুল্ক হার শূন্য অর্থাৎ কোনো শুল্ক নেই। বাংলাদেশের ট্যারিফ লাইনের আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে। যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তিন মাস সময় চেয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে চিঠি দেওয়ার পরও সেটি কার্যকর হয়নি। ফলে এখন শুল্ক আরোপের প্রভাব তৈরি পোশাক খাতে পড়ার আশঙ্কা সব উদ্যোক্তার ভেতর কাজ করছে। বিশেষ করে এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বাড়বে। এতে চাহিদা, বায়ারদের ক্রয়াদেশ ও মূল্য সমন্বয় তিনটি চাপ এসে পড়বে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ক্রেতা অর্ডার স্থগিত করেছে। অনেকে পরিস্থিতি আরও দেখছেন। এটি চলতে থাকলে উদ্যোক্তারা ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়বে, অনেক কারখানা বন্ধের শঙ্কা থাকবে। তবে প্রতিযোগী দেশ চীন, ভিয়েতনামে শুল্ক আমাদের চেয়ে বেশি। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
ঊষার আলো-এসএ