UsharAlo logo
শুক্রবার, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফ্যাসিস্টবিরোধী শিবিরে ভাঙনের পদধ্বনি, যা বললেন ছাত্রনেতারা

ঊষার আলো রিপোর্ট
ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫ ২:৪৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ফ্যাসিস্টবিরোধী শক্তির অন্যতম নিয়ামক হিসাবে খ্যাতি পাওয়া ছাত্র সংগঠনের শক্তিগুলো এখন ভবিষ্যৎ ছাত্র রাজনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখাসহ বহুমুখী স্বার্থ ও রাজনীতির নানা হিসাবনিকাশের মধ্যে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে।

সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ চরমে। বাড়ছে উত্তেজনা। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দায়ী করে প্রকাশ্যে বক্তব্যও দিচ্ছে। হামলার জন্য ছাত্রদলকে দোষারোপ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

অপরদিকে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছাত্রদের একাংশ বাধা দিলে এমন ঘটনার সূত্রপাত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্যাম্পাসগুলোয় প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করছে বলেও মন্তব্য করা হয়।

প্রসঙ্গত, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে বিরোধের জেরে মঙ্গলবার কুয়েটে ছাত্রদলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অর্ধশতাধিক আহত হন। দেশি অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে মঙ্গলবার কয়েক ঘণ্টা চলা সাধারণ ছাত্রদের ওপর ওই হামলার ঘটনায় জড়িত যুবদলের একজনকে এরই মধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে। আরও কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে ফ্যাসিস্টবিরোধী এসব ছাত্রশক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছে। অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা শহিদ হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন কমবেশি ৩০ হাজার। ফ্যাসিস্টবিরোধী শিবিরে ভাঙনের পদধ্বনিতে আশাহত সাধারণ ছাত্ররা।

তারা মনে করেন, এটি পুরো জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক শুধু নয়, এর মধ্য দিয়ে সর্বনাশের পদধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। এটি একধরনের অশনিসংকেতও বটে। এর পেছনে তৃতীয় পক্ষের দূরবর্তী ইন্ধন থাকতে পারে। তবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ফ্যাসিস্টবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন সময় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পালটাপালটি কর্মসূচি দিচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলো। আর এতে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে পরিস্থিতির দায় নিতে কোনো পক্ষই রাজি নয়। বরং দোষ চাপাচ্ছে একে অন্যের ঘাড়ে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ মনে করছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় সংঘাত বাড়ছে।

কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের হামলার ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকা ছাত্র সংগঠনগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালটাপালটি বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রদল, সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাস-এর পাশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এসব কর্মসূচি থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা যায় ছাত্র সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে নতুন করে সংঘর্ষে জড়ানোর শঙ্কাও দেখা দেয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ছাত্র সংগঠনের সমর্থকদের মধ্যেও চলছে তুমুল বাগ্যুদ্ধ।

এর আগে ৭ নভেম্বর ‘ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোসহ বিভিন্ন দেওয়ালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছবিসংবলিত পোস্টার সাঁটায় ছাত্রদল। বিষয়টি নিয়ে তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। পরে এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। এসব ঘটনায় দায় কোনো ছাত্র সংগঠন না নিয়ে একে অপরের ঘাড়ে চাপায়। আর এসব সমস্যা সমাধানের জন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর প্যারেন্ট সংগঠনের সিনিয়রদের হস্তক্ষেপে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা অতিজরুরি বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ফেসবুক পেজে মন্তব্য করেছেন, ‘ভাইদের যখন দেখি একে অন্যের রক্তের নেশায় মাতে, তখন সত্যিকারের ভয় লাগে। আতঙ্ক লাগে। সবচেয়ে বেশি হতাশ লাগে। এখানে যে পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হোক, সে তো আমার ভাই-ই। ৬ মাস আগেও একসঙ্গে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট খেয়েছি। এখন এসে তাদের মধ্যে হওয়া গ্যাঞ্জাম কোনোভাবেই বিন্দুমাত্র সুখকর কিছু হতেই পারে না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, ছাত্র সংগঠনগুলো মুখোমুখি হচ্ছে না। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে যারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে এবং এসব অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করছে, ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা তাদের মুখোমুখি হচ্ছে। একটি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের স্টাইলে ফের শিক্ষার্থী নির্যাতন শুরু করেছে; যা আমাদের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থি। ফলে এ সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। এটা থামানোর উপায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ স্টাইলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থানের আগে আমাদের কয়েকটি সমস্যা ছিল। যেমন: জোর করে মিছিলে নেওয়া, অন্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রমে বাধা দেওয়া এবং গেস্টরুম করানো। অভ্যুত্থানের পর এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। ছাত্রদল কাউকে জোর করেনি এবং বাধাও দেয়নি। এমনকি শিবিরের কার্যক্রমেও বাধা দেয়নি। কুয়েটে যখন ছাত্রদল ক্যাম্পাসের বাইরে ফর্ম বিতরণ শুরু করে, তখন ঝামেলা করা হলো। ছাত্রদল রাজনীতি করলেই কি সমস্যা, প্রশ্ন করেন তিনি।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম  বলেন, কুয়েটে একটি ছোট ঘটনায় বহিরাগত যুবদল ও বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগ স্টাইলে হামলা করা হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এগুলোর স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও তারাই (ছাত্রদল) ভিকটিম সেজে কর্মসূচি দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সবাইকে জুলাই স্পিরিট ধারণ করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। এসব ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ মনে করছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় সংঘাতের ঘটনা বাড়ছে। এ বিষয়ে ঢাবি শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা যখন জুলাই-আগস্টের আন্দোলন করেছি, তখন লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির বিরোধিতা করেছিলাম। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর একটি ছাত্র সংগঠনের বিরোধিতার কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখনো দেওয়া হয়নি। তারা ছাত্রলীগ স্টাইলে সন্ত্রাসী রাজনীতি ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে, যার প্রমাণ কুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলে এর কুফল কী হতে পারে, তা তুলে ধরেছেন তার এ সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্টে।

তিনি বলেন, ছাত্রদল-ছাত্রশিবির যদি এ মুহূর্তে মুখোমুখি হয়, নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কোনো পক্ষই সহজে পেছাবে না। উভয়ই নিজের অস্তিত্বের লড়াই জ্ঞান করে মারামারি করবে। হয়তো, ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে স্মরণকালের সর্বোচ্চ হতাহত ও লাশ দেখতে হবে এবার। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির যেভাবে নিজ নিজ অফিশিয়াল প্যাডে একে অন্যের নাম উল্লেখ করে দায় আরোপ ও হুমকি-ধমকি দিচ্ছে, এটা খুব খারাপ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। তিনি মনে করেন, এদের প্যারেন্ট সংগঠনের সিনিয়রদের হস্তক্ষেপে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা অতিজরুরি এবং একান্ত অপরিহার্য।

ঊষার আলো-এসএ