ঊষার আলো রিপোর্ট : প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নাম তিনবার উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তবে সেখানে ঋণ পাওয়ার জন্য সংস্থাটি যে শর্ত দিয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়নি। সংস্থাটি বাংলাদেশের প্রশংসায় বিভিন্ন সময়ে যেসব কথা বলেছে, সেটাই বাজেটে উল্লেখ করেছেন মন্ত্রী। তবে বাজেটকেন্দ্রিক অন্তত ২০টি পদক্ষেপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইএমএফ-এর শর্তের প্রতিফলন রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যে যেসব বিষয় সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে, সেগুলোই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানদের ওপর প্রভাব পড়ে-এ ধরনের শর্ত বাস্তবায়নে আপাতত হাত দেওয়া হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আইএমএফ। ইতোমধ্যে প্রথম কিস্তির টাকা ছাড় করেছে সংস্থাটি। তবে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তিন ধরনের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ।
এর মধ্যে রয়েছে-গুণগতমান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত, অবকাঠামোগত মানোন্নয়ন এবং সাধারণ শর্ত। তিন খাতে ছোট-বড় সব মিলিয়ে শর্তের সংখ্যা ৩০টি। গুণগত মানোন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত হচ্ছে বাধ্যতামূলক। এগুলো মানতেই হবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সংশোধন করা। বাজেট ঘাটতি যেন অসহনীয় পর্যায়ে না যায়।
অবকাঠামোগত মানোন্নয়নসংক্রান্ত শর্তের মধ্যে রয়েছে-অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বাড়ানো, নতুন আয়কর আইন সংসদে পাশ করে কার্যকর করা, জ্বালানির দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতি কার্যকর উল্লেখযোগ্য।
আর অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে-বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদের হার বাজারদরের ওপর ছেড়ে দেওয়া এবং ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো।
জানা যায়, আইএমএফ-এর শর্ত অনুসারে চলতি জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি অত্যন্ত কঠিন। কারণ, বর্তমানে নিট রিজার্ভ আছে ২০ বিলিয়ন ডলার। এরপর বিভিন্ন ব্যয় রয়েছে। অর্থাৎ, এক মাসেই আরও সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বাড়াতে হবে। তবে এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো কিছুই উল্লেখ করেনি অর্থ বিভাগ।
কিন্তু রিজার্ভ বাড়াতে আমদানি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির অন্যতম শর্ত হলো-প্রতিবছর জিডিপির দশমিক ৫০ শতাংশ হারে রাজস্ব বাড়াতে হবে। এর অংশ হিসাবে এবারের বাজেটে টিআইএনধারীদের করযোগ্য আয় না থাকলেও ২ হাজার সেবামূল্য দিতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন খাতে কর বাড়ানোর আরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শর্তের মধ্যে আরও রয়েছে-আয়কর ও কাস্টমস আইন এবং ভ্যাট সংগ্রহে অনলাইন নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলেছে সংস্থাটি। তবে ইতোমধ্যে আয়কর আইন চূড়ান্ত হয়েছে। কাস্টমস আইনের কাজ চলছে। অনলাইনে ভ্যাটও আদায় হচ্ছে।
আইএমএফ-এর শর্তে আরও রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হিসাব তিন মাস পরপর প্রকাশ করা। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কাজ শুরু করেছে। সরকারি কেনাকাটার জন্য আলাদা কমিটি গঠন। এ ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্দিষ্ট পর্যায়ে রাখা। চলতি মাসেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমদানি মূল্য সঠিকভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করা। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কম নেওয়া। বাজেটে এ খাত থেকে মাত্র ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হচ্ছে। গত বাজেটে যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা সমন্বয়ের উদ্যোগ নিচ্ছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এছাড়াও রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার একক বিনিময় হার। আগামী জুলাই অর্থাৎ নতুন অর্থবছর থেকে তা কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরিবেশদূষণ রোধে কার্বন কর নির্ধারণ। দুটি গাড়ি থাকলে অতিরিক্ত কর দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছে। এ নীতিমালার আওতায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জলবায়ুজনিত ঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজটি করতে হবে।
এ ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে। আর্থিক খাতে তদারকি বাড়ানোর কথা বলেছে আইএমএফ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে সরকার।
বাজেটে আইএমএফ-এর শর্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এবারের বাজেটে সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো মূল্যস্ফীতির ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
আইএমএফ-এর শর্ত অনুসারে যে সুবিধাগুলো কমানোর কথা ছিল, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে সেখানে হাত দেয়নি। এর মধ্যে রয়েছে কর কাঠামোয় হাত না দেওয়া এবং রপ্তানি প্রণোদনায় হাত না দেওয়া অন্যতম। তিনি বলেন, ধারণা করছি, নির্বাচনের পর সরকার এ বিষয়গুলোয় হাত দেবেন। তিনি আরও বলেন, বাজেট বক্তৃতায় আইএমএফ-এর সংস্কারের ব্যাপারে কথা বলা হয়নি। তবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে আইএমএফ-এর সংস্কারের বিষয়টি দেখা যায়।
ঊষার আলো-এসএ