ড. মো. রেজাউল করিম : এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত রুপকল্প ২০২১ এর অধীনে দেশের ডিজিটাইজেশন কার্যাবলির মূল কান্ডারি এটুআই। প্রোগ্রামটি সরকারের সেবা প্রদান সহজীকরণ ও পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশনের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নত ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল- সরকারের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো। বতর্মানে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের ভেতরে উদ্ভাবনী প্রয়াস চালাচ্ছে, যা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহকে জনমুখী সেবা উদ্ভাবন ও রূপান্তরে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এমপির নির্দেশনায় ২০১৫ সাল হতে বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশন ও বিচারিক সেবাসমূহ সহজীকরণে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে পাশে রয়েছে এটুআই প্রোগ্রাম। এর যুগোপযোগী, ব্যাপকভিত্তিক ও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের যেমন- ‘মিশন ডিজিটাল কোর্ট ২০২১’ এর কল্যাণে ডিজিটাল জগতে বিচার বিভাগের অগ্রগতি আজ দৃশ্যমান। বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশনে এটুআই এর উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ হলো:
বিচার বিভাগীয় বাতায়ন: বিচার বিভাগের তথ্য ভান্ডার : বিচার বিভাগীয় বাতায়ন হলো দেশের সকল আদালতকে নিয়ে বিচার বিভাগের জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল যা বিচারপ্রার্থী জনগণ ও বিচারাঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা দ্বারা সমৃদ্ধ।আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৫ সালে এ ওয়েবপোর্টাল তৈরির কাজ হাতে নেয়া হয়। এজন্য এটুআই প্রোগ্রাম এবং আইন ও বিচার বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বিচার বিভাগীয় বাতায়নের তথ্য ও সেবা সম্পর্কে বিচারকদের মতামত যাচাই করা হয়। তাদের মতামতের ভিত্তিতে কন্টেন্ট ও ডিজাইন আকাঁ হয় এবং বিচার বিভাগীয় বাতায়ন তৈরি করা হয়। মূল বিচার বিভাগীয় বাতায়ন কাঠামোর পাশাপাশি প্রতি জেলা আদালতের জন্য পৃথক ৬৪ টি জেলা আদালত বাতায়ন এবং ৫ টি মহানগর বাতায়ন তৈরি করা হয়। এরপর বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে বিচার বিভাগীয় বাতায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। কারণ এখানে বাংলাদেশের সকল আদালত এবং বিচার বিভাগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্যাদি এক মুহূর্তেই পাওয়া যায়। এছাড়া মামলার বিচার পদ্ধতি, সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান, বিচারিক কাজে প্রয়োজনীয় সকল ফরম, বিভিন্ন ধরণের অপরাধের প্রতিকার পাওয়ার স্থান, ঠিকানা, মামলা দায়েরের স্থান, কোর্ট ফি, মামলার মূল্যমান, আদালত কাঠামো, আইন-অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ও সেবা পাওয়া যায়।
অনলাইন কজলিস্ট ব্যবস্থাপনা সিস্টেম : বাংলাদেশের বিচারাদালতসমূহে কাগজে মুদ্রিত কার্যতালিকা (কজলিস্ট) এর পরিবর্তে অনলাইনে প্রাত্যহিক কজলিস্ট প্রকাশ এবং ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ বিচার বিভাগে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। আর এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে রয়েছে সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বিচারপ্রার্থী জনগণ দেশের যে কোন প্রান্তে বসে অনলাইন কার্যতালিকা থেকে মামলার সর্বশেষ তথ্য জানতে পারবেন। কোন মামলা, কি অবস্থায় আছে; সর্বশেষ তারিখে কী আদেশ হয়েছে; পরবর্তী তারিখটি কবে এবং কেন ধার্য আছে- এসকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি অনলাইন কার্যতালিকায় থেকে দেখে নিতে পারবেন। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্যাদি প্রিন্ট করেও নিতে পারবেন। এতে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী ও বিচার সংশ্লিষ্টদের সময়, অর্থ ও যাতায়াতের সাশ্রয় হবে। বিচার কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আসবে। যা মামলার জট কমাতে সহায়তা করবে এবং জনগণের কষ্ট লাঘব করবে।
বিচার বিভাগীয় ড্যাশবোর্ড : কোন সংস্থার তথ্য উপস্থাপনে ড্যাশবোর্ড একটি অনন্য ও শক্তিশালী মাধ্যম। সেই প্রেক্ষিতে, বিচার বিভাগীয় ড্যাশবোর্ড হলো এমন একটি ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল (Information Management Tool) যা অধস্তন আদালতসমূহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করে। এছাড়া ড্যাশবোর্ডটি গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ (Monitoring) ও অনুসরণ (Tracking) মাধ্যমও বটে। এতে আদালতসমূহে বিচারাধীন এবং নিষ্পত্তি হওয়া মামলা সম্পর্কিত সকল প্রকার তথ্য-উপাত্ত এবং দেশের সকল জেলা লিগ্যাল এইড অফিসসমূহের বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলির বিবরণ সন্নিবেশিত থাকে। এ ড্যাশবোর্ড শুধু বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ বা অন্ত:ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। অর্থাৎ এতে কেবল বিচার প্রশাসনে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ ও সিদ্ধান্ত গ্রহীতাগণ, বিচার কাজে নিয়োজিত সকল বিচারকগণ এবং অধস্তন আদালতের স্টাফদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এর বাইরে মামলার কোন পক্ষ, আইনজীবী এবং বিচার সংশ্লিষ্ট অন্য কারো এ ড্যাশবোর্ডে প্রবেশাধিকার রাখা হয়নি। বিচার বিভাগীয় ড্যাশবোর্ড দ্বারা বিচার বিভাগের কার্যাবলির নানাবিধ তথ্যের অবাধ প্রবাহ, জুডিসিয়াল সার্ভিসে অধিকতর স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা সম্ভব। চূড়ান্তভাবে এটি বিচার বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত ও উন্নত বিচারিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করে মামলা জট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটুআই প্রোগ্রাম হতে বিচার বিভাগের জন্য গৃহীত ‘মিশন ডিজিটাল কোর্ট ২০২১’ এর অধীনে অধস্তন আদালতের কেস ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার অধিকতর উন্নয়নের স্বার্থে স্মার্ট ও ডিজিটাল টুল যেমন- জুডিসিয়াল মনিটরিং ড্যাশবোর্ড প্রস্তুতকরণ এবং মাঠ পর্যায়ে এগুলোর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে এটুআই জুডিসিয়ারি টিমের তত্ত্বাবধানে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর ড্যাশবোর্ডটির ‘ভার্সন ২০২০’ তৈরির কাজ সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করা হয়। এরপর এটুআই এর আর্থিক সহায়তায় ড্যাশবোর্ডের ওপর জেলা পর্যায়ের ৩৫২ জন বিচারককে টিওটি হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সর্বশেষ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের আর্থিক সহযোগিতায় এটুআই জুডিসিয়ারি টিমের সদস্যরা দেশের ৬৪ টি জেলায় ও পাঁচটি মহানগর পর্যায়ের এক হাজার ৬০০ বিচারক এবং ২ হাজার অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সাফল্যের সাথে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে।
ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনা : চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, অ্যাপস্ প্রস্তুতকরণসহ যাবতীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে এটুআই প্রোগ্রাম। এছাড়া এটুআই এর মুক্তপাঠ- ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে “আমার আদালত: ভার্চুয়াল কোর্টরুম” এর ব্যবহার বিধির উপর ১০ হাজার ২১৩ জন বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ফলে করোনার মহামারীকালেও দেশের বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত হয়। সকল কার্যক্রম থেকে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশনে এটুআই প্রোগ্রামের অবদান অপরিসীম। এটুআই গৃহীত পদক্ষেপসমূহ পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হলে বিচার বিভাগ বিচারিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বহুধাপ এগিয়ে যাবে। সেজন্য বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশনের জন্য এটুআই এর চলমান কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখা জরুরি। লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
(ঊষার আলো-আরএম)