ঊষার আলো রিপোর্ট : গদিচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই ভারত খুব পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিশেষ করে হিন্দু নির্যাতনের গুজব ছড়িয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে আন্তর্জাতিক মহলে সাম্প্রদায়িক সরকার হিসাবে তুলে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশবিরোধী এ প্রোপাগান্ডায় শুধু ভারতীয় মিডিয়া জড়িত বলে এতদিন যে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, তা সত্য নয়। এর পেছনে যে ভারত সরকারও জড়িত, তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে নারী ও শিশু নিপীড়নের দোষে দোষী ইসকন থেকে বহিষ্কৃত তথাকথিত ধর্মগুরু চিন্ময় দাস সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আটক হওয়ার পর তা আরও পরিষ্কার হয়েছে। চিন্ময় ইস্যু নিয়ে ভারত অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। আদালত থেকে জামিন না পাওয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে, তা ছিল কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। ভারতের বিবৃতি ছিল অতিরঞ্জিত ও অসত্য তথ্য দিয়ে ভরা। আপত্তিকর শব্দে সাজানো ভারতের বিবৃতিটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি, তিনি যে বর্ণের বা ধর্মের বিশ্বাসেরই হোক না কেন, বাংলাদেশ প্রচলিত বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারত গায়ে পড়ে যে আচরণ শুরু করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের এ ন্যক্কারজনক আচরণকে তাই বাংলাদেশের জনগণ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ সরকার পালটা বিবৃতি দিয়ে তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছে। তারপরও ভারত থেমে নেই। বাংলাদেশে ধর্মীয় দাঙ্গা লাগানোর লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অসত্য ও অপতথ্য প্রচারের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ার উপস্থাপকদের মুখের অমার্জিত ভাষা, উচ্চস্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি এবং শরীরের অরুচিকর অঙ্গভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যা সভ্য সমাজের মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
তা ছাড়াও, এযাবৎ ভারতকে হাসিনার দেওয়া অন্যায্য সুবিধাসহ সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করবে কিনা, সে ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে তারা। যেমন-বাংলাদেশের কোস্টাল এলাকায় রাডার স্থাপন প্রকল্প, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ১৩টি পয়েন্টে রেল যোগাযোগ স্থাপন প্রকল্প, যাতে ভারত তার প্রয়োজনে যে কোনো সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিক সরঞ্জামাদি ও বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহণ করতে পারে। এছাড়াও ভারতের ‘শিলিগুড়ি চিকেন নেক’ এড়িয়ে সামরিক ভারি ও হালকা সরঞ্জামসহ অন্যান্য পণ্য পরিবহণের সুবিধার্থে পরিকল্পিত পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসামের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোর যে কোনো একটিও যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো সরকারপ্রধান রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী এমন আত্মঘাতীমূলক চুক্তি কখনো স্বাক্ষর করতেন না। এ কথা ভারতও জানে। তাই তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এ দেশের জনগণ নয়, হাসিনাই তাদের প্রকৃত বন্ধু। আশ্রয় দিয়ে শুধু বসে থাকেনি, হাসিনাকে পুনর্বাসনের অভিলাষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের ওপর অব্যাহতভাবে তীব্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা লাগিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাইছে।
ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে যে আচরণ করছে, তা নতুন নয়। অতীতেও ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এর চেয়ে জঘন্য আচরণ করেছে। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাসহ দলটির অন্য নেতাদের আগরতলায় ডেকে পাঠায় ভারত। সেখানে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এক গোপন বৈঠকে সন্তু লারমাদের তথাকথিত ‘জম্মু ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করতে বলেছিল। বিনা অর্থে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও তখন দেওয়া হয়েছিল। গোপন বৈঠকের দুসপ্তাহের মধ্যে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র ক্যাডার তথাকথিত ‘শান্তি বাহিনী’ গঠন করে প্রশিক্ষণও দেওয়া শুরু করেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। সে সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল তারা। ভারত শান্তি বাহিনীকে অব্যাহত অস্ত্র-গোলাবারুদসহ সব ধরনের রাজনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংকটকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর শেষ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি স্তিমিত হয়। এবার শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার তোপের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারত প্রথমেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করেছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ভারত সম্ভবত এবার আগের সেই পথে পা বাড়াবে না। কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্য নিয়ে ভারত এমনিতেই ঝামেলায় আছে। মণিপুরে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে; সম্প্রতি মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল দুহোমা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। লাল দুহোমা এ আহ্বান এক মাস আগে দিলেও এতদিন তা গোপন রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি ভারতের কিছু স্বল্প প্রচারিত গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান রক্ষায় শপথ গ্রহণকারী একজন মুখ্যমন্ত্রী কতটা মরিয়া হলে এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। এসব পরিস্থিতি নিশ্চয়ই ভারতের জন্য শুভলক্ষণ নয়। অতএব, এসব কথা বিবেচনা করে ভারত বোধহয় আগের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বেশি দূর এগোনোর সাহস করবে না। কারণ ভারত জানে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো নিয়েও তাকে বিপাকে পড়তে হবে।
ভারত সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সেখানকার একশ্রেণির উগ্রবাদী মানুষ বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে যে এত উচ্চবাচ্য করছে, তারা তাদের নিজ দেশের সংখ্যালঘু মানুষের-ই বা কতটুকু নিরাপত্তা দিতে পারছে? ভারত তার নিজের দেশে যেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা কেন? একবারও কি নিজেদের প্রশ্ন করে দেখেছে, গত এক দশক ধরে সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের সঙ্গে তারা কী আচরণ করছে? ১০ বছরে দেশটিতে কমেছে সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা; যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মুসলিম নিধনের মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কিছুদিন আগেই ভারতের উত্তরপ্রদেশের সামভালে মুঘল আমলের একটি মসজিদকে ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ তিনজন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করে এবং সেই ঘটনায় ৩০ জনের মতো আহত হন। অতীতে দেশটিতে মুসলিম হত্যার রেকর্ডও ভালো নয়। দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় প্রায়ই হিন্দু-জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা সহিংস আক্রমণ ও হামলার শিকার হয়েছে। অতীতে এ আক্রমণগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসাবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার পরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানও ঘটে এবং তারপর থেকেই মুসলিমদের ওপর এ আক্রমণগুলো আরও নিয়মতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, যা ধীরে ধীরে রাষ্ট্র-অনুমোদিত কার্যক্রমের আকার নিয়েছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মীয় সহিংসতায় এ পর্যন্ত আনুমানিক ১৭ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছেন। বিজেপির শাসনামলেই দেশটিতে বেড়েছে মুসলমান কয়েদির সংখ্যাও। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মুসলমান হলেও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে ভারতের কারাগারে বন্দিদের মধ্যে ১৯ দশমিক ১ শতাংশই মুসলিম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নরেন্দ্র মোদি একে একে ঐতিহ্যবাহী ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের নোংরা খেলায় মেতেছেন। বাবরি মসজিদের পর এখন আবার মোদির আজমির শরিফের ওপর চোখ পড়েছে। শুধু মুসলিমই নয়, ভারতের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষও নিরাপদে নেই। মণিপুরে চলছে সংখ্যালঘু নির্যাতন। গত বছরেই দুই কুকি নারীকে প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে শ্লীলতাহানি করা হয় রাজ্যটিতে। দাঙ্গায় প্রাণ যায় প্রায় ৩০০ মানুষের। ভারত নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দাবি করলেও কট্টরবাদী হিন্দু নরেন্দ্র মোদি দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে তোড়জোড় করছেন।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত যে আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করছে, তা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য ভালো নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ভারত কি সত্যিই বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়? ভারত যদি সে ইচ্ছে পোষণ করে, তাহলে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে তাদের মেনে নিতে হবে। ভারতকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ওপর সর্বাত্মক চাপ সৃষ্টি করেও তাদের কোনো ইচ্ছার প্রতিফলনই এখানে ঘটাতে পারবে না। ভারতকে এ-ও মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছে। আমাদের স্বাধীনতায় ভারতের যতটুকু অবদান আছে, তা আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব। তার মানে এই নয়, শেখ হাসিনা এতদিন ভারতকে যে অন্যায্য সুবিধাদি দিয়ে গেছে, বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তা মেনে নেবে। এ লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন ঢাকায় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের মিটিং শুরু হবে। আশা করি, এ মিটিংয়ে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারসাম্যমূলক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়ে ভারত তাদের আন্তরিক মনোভাব প্রকাশ করবে।
ঊষার আলো-এসএ