UsharAlo logo
শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্ত চিন্তার অধিকার

koushikkln
জুন ১১, ২০২১ ৯:০৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সনাতন ধর্মের অনুসারীরা তাদের তাত্ত্বিক চিন্তায় ও তার বাস্তব প্রয়োগে কতোটা স্বাধীনতা ভোগ করে তা নিয়ে আজকের এই আর্টিকেলে আলোচনা রাখতে চাই। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের অনুসারীগণ তাদের শাস্ত্রের একক নির্দেশনার বাইরে বিকল্প কিছুই ভাবতে পারে না। সে সুযোগ তাদের নেই। এক মত ও এক পথের ধর্ম সেগুলি। কিন্তু হিন্দু ধর্ম তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে বহু মত ও বহু পথ শাস্ত্রীয়ভাবে অনুমোদিত। গীতায় বলা হয়েছে “যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম, মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষাঃ পার্থ সর্বশঃ।” অর্থাৎ যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে আমি তাকে সেইভাবে ধরা দিয়ে থাকি।

এটাকে আরো সহজ করে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বললেন- “যত মত তত পথ।” মতাদর্শগত বহু পার্থক্য নিয়ে এই ধর্ম চলমান। এখানে একদল মানুষ দেবাদিদেব মহেশ্বরকে পূজা করছে, শিব লিঙ্গে জল ঢালছে। আরেক দল উলঙ্গ ও বিভৎস প্রতিমা মা কালীর পূজা করছে। তারা শক্তির উপাসক। তাই তাদেরকে বলা হয় শাক্ত। কিছু সংখ্যক মানুষ বিষ্ণুদেব ও তাঁর অবতারে পূজা করছে। তারা বৈষ্ণব। জৈনধর্ম ও শিখধর্ম এক সময়ে সনাতন ধর্মের অন্তর্গত ছিলো। পরবর্তীকালে তারা স্বতন্ত্র হয়ে গেছে। বৌদ্ধধর্মও সনাতন মত। সেইজন্য গৌতম বুদ্ধকে হিন্দু ধর্মের অবতার হিসেবে গণ্যও করা হয়। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধধর্ম হলো রপ্তানিযোগ্য হিন্দু ধর্ম। হাল আমলে আমরা দেখি লোকনাথ বাবার মতাদর্শ, অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ, মতুয়া মতাদর্শ ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে অসংখ্যা দেব দেবতার পূজার্চনা। যেমনঃ দুর্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কার্তিক পূজা, সরস্বতীপূজা, গণেশপূজা ইত্যাদি। শীতলা পূজা, মনসা পূজা, গাছ পূজা এগুলো আঞ্চলিক দেবতার পূজা।

একসময়ে অনাবৃষ্টিজনিত কারণে ফসল নষ্ট হতো। তখন মানুষ সমবেতভাবে বরুণ দেবতার পূজা করতো বৃষ্টিপাতের জন্য। কোনো কোনো অঞ্চলে পশুকেও পূজা করা হয়। এরপর রয়েছে খাদ্যাভ্যাসজনিত ভিন্নমত। কোনো পূজায় আমিষ চলে আর কোনো পূজায় আমিষ নিষিদ্ধ। বৈষ্ণব ও সৎসঙ্গীরা পুরোপুরি নিরামিষ জীবনের বিধান দেয় আর মতুয়া, রামকৃষ্ণ মিশনের অনুসারীগণ আমিষ আহারী। এই ধর্মে সাকার পূজার বিধান আছে, আবার নিরাকারও আছে। শাস্ত্র বলছে ” ঈশ্বর স্মর্যাতে, ন দৃশ্যতে। ” অর্থাৎ ঈশ্বরকে স্মরণ করা যায়, দেখা যায় না। তাই তাকে দেখার জন্য কল্পিত মূর্তরূপ প্রতিষ্ঠা করে তাতে প্রাণ সংযোগ করা হলো। হয়ে গেলো চিত্তযুক্তগুণের মাটীর রূপ। মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ীরূপে পূজা হলো শুরু। যারা ঈশ্বরের স্বরূপ বুঝতে পারে না তাদের সামনে এলো রূপক অর্থে ভগবানের প্রতিমূর্তি। নিরাকার সাকারের মেলবন্ধন হয়ে গেলো। তাহলে দেখা যাচ্ছে চিন্তা চেতনায় অসংখ্য বিরূদ্ধবাদী মতাদর্শ, ধ্যান ধারণা প্রচলিত এই ধর্মের অভ্যন্তরে। তথাপি এই ধর্ম টিকে আছে এক অদ্ভুত একতার ঐকতান নিয়ে। কোথায় সেই অদৃশ্য নাড়ির যোগ তাই খুঁজে দেখা দরকার। এই একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ভারতবর্ষ যেখানে অসংখ্য ভিন্নতা আছে, তারপরেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। Unity in diversities. ভারতবর্ষ যে নাড়ির টানে ঐক্যবদ্ধ, হিন্দু ধর্মও একইভাবে ঐক্যবদ্ধ। তাই ভারত আর ভারতের ধর্ম একই প্রকৃতির। এই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিলো আনুমানিক ৭০০০ বছর আগে। তারপর বহু অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে এই ধর্মকে। কিন্তু এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে।

চিন্তার স্বাধীনতা হিন্দুদের সংঘবদ্ধ হওয়ার পথে একটি বড় বাধা। তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এটা তার উদারতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় বহন করে। হিন্দু ধর্ম হলো উদারতান্ত্রিক মন মানসিকতার এক মুক্ত মঞ্চ। মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা আছে বলেই এই ধর্ম পরিবর্তনশীল। পরিবর্তন পরিবর্ধনের মাধ্যমে এই ধর্মের সংস্কার সাধন করা যায়। সংস্কারযোগ্যতাই ধর্মকে যুগোপযোগী করে তোলে। তাকে আধুনিক করা যায়। যুগের প্রয়োজনকে যদি স্বীকার করতে হয় তবে সংস্কার সম্পন্ন হতেই হবে। তাই হিন্দু ধর্ম চলবে তার আপন মহিমা নিয়ে সামনের দিকে। সে স্থবির হবে না। অভিযোজন ক্ষমতা তার প্রাণ। যারা ধর্মের কাছ থেকে ন্যায় বিচার না পেয়ে মন খারাপ করে আছেন তাদের কাছে আমার একখানা প্রশ্ন আছে। ধর্ম কি আপনাকে বঞ্চিত করেছে, নাকি আপনার প্রাপ্যতা বুঝে নিতে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন? ধর্মের স্বরূপ না বুঝে ধর্মের ঘাড়ে নিজের অযোগ্যতার দায় চাপালে তো চলে না। ধর্মকে ব্যবহার করে অনেক বঞ্চনা সমাজে হয়েছে। দায় চাপানো হয়েছে ধর্মের উপর। অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অসংঘবদ্ধতা ইত্যাদি কারণে মানুষ বঞ্চিত হয়। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে নিজের দুর্বলতা অন্যের উপর চাপিয়ে আত্মতৃপ্তির সন্ধান করা। ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেলে তার দায় ডাক্তারের। অবশ্যই চিকিৎসা বিজ্ঞানের নয়। কিন্তু আমরা চিকিৎসা শাস্ত্রের দোষ দিয়ে অদক্ষ ডাক্তারকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। বিষয়টির গভীরতা যদি ভাবি একবার তবেই তার মর্মার্থ উদঘাটন করা সম্ভব।

লেখক: প্রশান্ত কুমার রায়, সদস্য, ট্যাক্সেস এপিলেট ট্রাইব্যুনাল, বেঞ্চ-৪, ঢাকা।