UsharAlo logo
রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যোগ্যতা বনাম ন্যায্যতা

koushikkln
জুন ৮, ২০২১ ৬:৪৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে – Deserve first, then desire. অর্থাৎ যা তুমি চাও তার জন্য যোগ্যতার পরিচয় দাও। যোগ্যতার পরিচায়ক কী কী? শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান, ধন, জন, মান, শক্তি, সাহস, মনোবল, নৈতিকতা এইরূপ অসংখ্য সূচকে মানুষের যোগ্যতা পরিমাপ করা হয়। যোগ্যতা অনুসারে ন্যায্যতা পাওয়া গেলে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সমতা মানে সকলের সমান অধিকার নয়, সমতা মানে ন্যায্যতা অনুসারে প্রাপ্যতার নিশ্চয়তা।

মানুষ সকলেই সমান কখনো হতে পারে না। মানুষে মানুষে শক্তি সামর্থ্যের পার্থক্য থাকে। অযোগ্য ব্যক্তি আর যোগ্য ব্যক্তির মধ্যে সমান সুযোগ বণ্টন করলে তাকে সাম্য বা ন্যায় বিচার বলে না। সুতরাং সকল সম্পদ সকল মানুষের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করার কোনো সুযোগ নেই। মানুষ নিজেও তা চায় না। ধন সম্পদের বেলায় যেমন মান, সম্মান, সামাজিক মর্যাদা সকল ক্ষেত্রেই একই নিয়ম প্রযোজ্য। তবে কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীভুক্ত সম্প্রদায়ের সকল মানুষকে যখন একই মর্যাদা বা সুযোগ দেয়া হয় তখন তা অন্যায়। কোনো সম্প্রদায় বিশেষের সকল ব্যক্তি একই যোগ্যতার নয়। সুতরাং সম্প্রদায়গতভাবে সম অধিকার প্রদানযোগ্য হতে পারে না। একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের একজন অযোগ্য ব্যক্তি আরেক সম্প্রদায়ের যোগ্যতম ব্যক্তির চেয়ে অধিক মর্যাদাবান হলে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হলো না। আমি একটু স্পষ্ট করে বলি। একজন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অশিক্ষিত মানুষ একজন তথাকথিত শূদ্রজাতির সর্ব গুণে গুণান্বিত ব্যক্তির চেয়ে অধিক মর্যাদা দাবী করলে তা ন্যায় সংগত হয় কি করে? আমি শাস্ত্রীয় বিধানের ব্যাপারে কথা বলছি না। আমি বাস্তবতার কথা বলছি। শাস্ত্রে যে গুণভিত্তিক জাতপাতের বিধান আছে বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে জন্মের ভিত্তিতে মানুষের পরিচিতি তৈরি হচ্ছে । এই জাতপাত ব্যবস্থার উঁচুতে যার অবস্থান তিনি অবস্থানগত কারণে একটি সুযোগ পেয়ে থাকেন। ফলে এর বিপক্ষে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেন না। দুই একজনকে কিছু কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা অন্তর থেকে এর বিলোপ চান না।
আবার অন্যদিকে যারা জাতপাত প্রথার নীচুতে অবস্থান করছে তারাও ভিতরে ভিতরে বর্ণবাদী যা তারা নিজেরাই জানে না। মানুষ সব সময় নিজেকে অন্যের চেয়ে সেরা ভাবতে ভালোবাসে। এটা হিউম্যান সাইকোলজি। আর এই সেরা ভাবার মনোভাব থেকেই আত্মগরিমা বা অহংকারের জন্ম হয়। সেই জন্য মাথা নত করার শিক্ষাই গীতার সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেখানে বলা হয়েছে তুমি কিছু ত্যাগ করতে চাইলে সর্বাগ্রে তোমার অহমিকা ত্যাগ করো। মানুষ সব সময় নিজেকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে। তাই সেরা ত্যাগ হলো অহমিকা ত্যাগ। মাস ল’ নামের একজন মনোবিজ্ঞানী মানুষের চাহিদাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। তার সবার উপরে আছে সুপার ইগো। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তাই কবি গুরু গীতার সুরে সুর মিলিয়ে ইগোর বিপরীতে মাথা নত করার তত্ত্ব দিয়েছেন। আত্ম সমর্পণের নমুনা একটি কবিতায় চমৎকারভাবে প্রতিভাত হয়েছে। তিনি লিখেছেন –
“আমার মাথা নত করে দাও হে, তোমার চরণ ধূলার তলে- সকল অহংকার হে আমার, ডুবাও চোখের জলে।

অহমিকাকে তিনি মলিন পোষাকের সাথে তুলনা করেছেন এবং তা পরিত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন।
” এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে, হবে গো এইবার- আমার এই মলিন অহংকার। ” পরিত্যাগের উপায় কী বলেছেন?
“স্নান করে আয় এখন তবে
প্রেমের বসন পরতে হবে।
সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে
গাঁথতে হবে হার
ওরে আয় সময় যে নেই আর।”
গুরুদেব রাস্তা বাতলে দিলেন। প্রেমের বসন পরতে বললেন। প্রেম ভালোবাসা দিয়েই অহমিকার পতন হয় আর সমাজে সমতা স্থাপন করা যায়।

লেখক: প্রশান্ত কুমার রায়, সদস্য, ট্যাক্সেস এপিলেট ট্রাইব্যুনাল, বেঞ্চ-৪, ঢাকা।