ঊষার আলো রিপোর্ট : বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেটে মূল বরাদ্দ থেকে বিদ্যুৎ খাতে ২৫, প্রশিক্ষণে ৫০ ও জ্বালানিতে ২০ শতাংশ ব্যয় স্থগিত করা হয়েছিল। একইভাবে উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয়ের রেশ টানতে জুড়ে দেওয়া হয় নানা শর্ত। সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে এ ধরনের কঠোর সমন্বয়ের পরও খুব বেশি অর্থ সাশ্রয় হয়নি। কারণ সাশ্রয়ের বড় অংশই পুনরায় চলে গেছে, অস্বাভাবিক ভর্তুকি ও ঋণের সুদ ব্যয়ের পেছনে। ফলে একদিকে সাশ্রয়, অন্যদিকে ব্যাপক অর্থের চাহিদা-এমন কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে চলতি বাজেটের আকার কমানো হয়েছে ১৭ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ফলে চূড়ান্ত সংশোধিত বাজেট দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ এবং ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির’ বৈঠকে সংশোধিত বাজেটের আকার তুলে ধরা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
সূত্র মতে, ওই বৈঠকে চলতি বাজেটের আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে মোটা দাগে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্যয়ের মোট আকার কাটছাঁট করা হয় ১৭ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কমানো হয়েছে ১৮ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা। এছাড়া মূল বরাদ্দ থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে ১০৯৩ কোটি টাকা এবং শেয়ার ও ইকুইটিতে বিনিয়োগ কমানো হয় সাত হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। অপরদিকে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পণ্য ও সেবা কেনাকাটায় সাশ্রয় হয় ছয় হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। তবে বড় ধরনের ব্যয় হ্রাস ও বরাদ্দ কাটছাঁটের মাধ্যমে বড় ধরনের সাশ্রয় হলে এর অধিকাংশই চলে যায় অতিরিক্ত ভর্তুকি ও ঋণ সুদ পরিশোধ ব্যয়ে। এই দুটি খাতে মূল বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত ৩০ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, সামষ্টিক অর্থনীতি এখন স্বল্প মেয়াদে সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনীতির স্বাভাবিক গতির বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি মানুষের সঞ্চয় ও ক্রয় ক্ষমতা কমিয়েছে। অনেকে ঋণ করছে। এ পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে। কারণ ওই ঘাটতির চাপই মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয়। এখন প্রয়োজন ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আনা। কারণ বড় ঘাটতি মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে বাজেটে ঘাটতি কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিতে হবে।
প্রত্যাশার কথা হলো এ বছর রাজস্ব খাতে কোনো কাটছাঁট করা হয়নি। অর্থবছরের শুরুতে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বহাল রাখা হয়েছে। এর কারণ হিসাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের চিত্র তুলে ধরে বৈঠকে। সেখানে বলা হয়, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি এই সাত মাসে এক লাখ ৯৬ হাজার ৩৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে একই সময়ে আদায় ছিল এক লাখ ৭৯ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এই ধারা আগামীতে অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হয়। এছাড়া ‘এনবিআর রাজস্ব’ লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট না করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকৃত আদায় হয়েছে মূল লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে আদায়ের হার ছিল ৫৫ শতাংশ। পাশাপাশি ‘নন-এনবিআর রাজস্ব’ লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে প্রকৃত আদায় হয়েছে মূল লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল অনুরূপ। আর ‘করবহির্ভূত রাজস্ব’ আদায়ের ক্ষেত্রে একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কো-অডিনেন্স কাউন্সিল বৈঠকে। এনবিআর তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, এ খাতে প্রথম নয় মাসে প্রকৃত আদায় মূল লক্ষ্যমাত্রার ৫৪ শতাংশ, যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় ছিল ৫১ শতাংশ।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ভালো হবে এমন প্রত্যাশার কথা বলেছেন। ফলে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রেখেই চলতি বাজেট সংশোধন করা হয়েছে।
সূত্র মতে, চলতি বাজেটের আকার কমানো হলেও এই সময়ে বরাদ্দ বেড়েছে সরকারের পরিচালন খাতে। অর্থবছরের শুরুতে চার লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা ধরা হয় পরিচালন ব্যয়। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এসে তা বেড়ে চার লাখ ৩২ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে নয়শ কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্য, গ্যাস ও সারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পাশাপাশি সংকট সৃষ্টি হয় মার্কিন ডলারের। এতে টাকার বিপরীতে বেড়ে যায় ডলারের দাম। ডলার ও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি আমদানি ব্যয়কে এক ধরনের উসকে দেয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার ও খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যায়। অপরদিকে সাশ্রয় মূল্যে এসব পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ভর্তুকিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। অর্থ বিভাগের হিসাবে শুধু কৃষি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যে অতিরিক্ত ভর্তুকি গুনতে হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি ডলার মূল্যবৃদ্ধিসহ অতিরিক্ত অভ্যন্তীরণ ঋণের সুদ পরিশোধে বাড়তি ব্যয় হবে ৯৬৩৮ কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরে খাদ্য, কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এসব খাতে মোট ভর্তুকি দাঁড়াবে ৬০ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।
এদিকে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) ক্ষেত্রে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে ব্যয়ের রেশ টেনে ধরা হয়। শুরুতে ২ লখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের এডিপি ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
ঊষার আলো-এসএ