ঊষার আলো রিপোর্ট :ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। আগে দেওয়া ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় তুলে নেওয়ায় এবার বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় অনিশ্চিত বা মন্দ হিসাবে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায় উঠেছিল।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর প্রতিবেদনটি অনুমোদন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী-২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। এর বেশি হলেই তা ঝুঁকি। বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ ঝুঁকির চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। প্রকৃত হিসাবে খেলাপি ঋণ আরও বেশি হবে। কারণ, অবলোপন করা ঋণ, বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করাসহ আরও অনেক ঋণ রয়েছে যেগুলোর খেলাপির যোগ্য কিন্তু খেলাপি করা হচ্ছে না। প্রলেপ দিয়ে নিয়মিত রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে খেলাপি ঋণ যা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। কারণ খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
অর্থঋণ আদালতে বিপুল অঙ্কের ঋণ আটকে আছে। পুনঃতফসিলের আড়ালে আছে বড় অঙ্কের ঋণ। এছাড়া ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে অনেক টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছে না তাদের শাস্তি না নিয়ে নানাভাবে ছাড় দিয়েছে। এ কারণে খেলাপিরা ঋণ শোধ করছে না। বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে খেলাপি ঋণ বাড়তেই থাকবে। তাই যারা ঋণখেলাপি তাদের ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। ঋণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। যারা ঋণ পরিশোধ করবে না তাদের শাস্তি দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, একের পর এক ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। সে কারণেই বর্তমানে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। অনেক ভুল নীতি ছিল। এখন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি বাড়বে। কারণ এটা বাস্তব। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এর থেকে বের হওয়ার পথ কি হবে। দেখতে হবে খেলাপির কী আছে। হয় সব বিক্রি করে, না হয় তাকে আরও কিছুদিন সময় দিয়ে এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। ৩ মাস আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকায়। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এর আগে ২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেই হিসাবে গত বছরের মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ শেষে সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ খেলাপি।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে আলোচিত সময় ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এ খাতে খেলাপি ঋণ ৬৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ খেলাপি এবং বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর ৩৬ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।
ঊষার আলো-এসএ