ঊষার আলো রিপোর্ট: আগামী অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতিতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের আংশিক প্রতিফলন থাকছে। মুদ্রানীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার মতো আইএমএফ’র ছয়টি শর্ত ছিল। সেগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিট হিসাব প্রকাশের শর্তটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাকি পাঁচটি শর্তের আংশিক প্রতিফলন থাকছে মুদ্রানীতিতে। এসব শর্ত পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এবারের মুদ্রানীতিকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব এবং মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতি অনুসরণ করা হবে। কেননা ২০১৯ সাল থেকেই অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া ছিল। ২০২০ সালে করোনার কারণে এটি প্রকট রূপ ধারণ করে। সেই মন্দার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় বৈশ্বিক মন্দা। এসব কারণে দেশের অর্থনীতিও মন্দায় আক্রান্ত হয়। এতে বিনিয়োগ কমেছে, কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূলত ২০১৯ সালে বেকারদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে এবারের মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। এজন্য কিছু খাতে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে।
সূত্র জানায়, আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী চলতি জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস হিসাব প্রকাশ করলেও জুলাই থেকে রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করা হবে। এর মাধ্যমেই আইএমএফ’র আরও একটি শর্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে।
আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার, ডলারের একক দর নির্ধারণ ও ঋণের সুদের হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আংশিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ডলারের দাম বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফারেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। যেটি এখনো হচ্ছে। এটি একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যে ডলার বিক্রি করে সেটির দরও বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করবে। এটিও বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে না। তবে বাজার দরের সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনা হবে। বর্তমানে ডলারের হরেক রকম দর প্রচলিত রয়েছে বাজারে। সেগুলোকে একক একটি দরে নিয়ে আসার শর্ত রয়েছে আইএমএফ’র। এটি নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে এটি এখনই সম্ভব হচ্ছে না। আপাতত ডলারের বিভিন্ন উপকরণের বিভিন্ন দর থাকবে। পর্যায়ক্রমে ডলার ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য দর কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে। যাতে ব্যবধান কমে যায়।
ঋণের সুদের হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া হবে। তবে সুদের হার একেবারের বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে না। লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) মতো এখানেও ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ৩ শতাংশের একটি ক্যাপ দেওয়া হবে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো সুদের হার ট্রেজারি বিলের সুদের হারের চেয়ে ঋণের সুদ ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারবে।
আইএমএফ’র আরও একটি শর্ত ছিল-চলতি জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ নবায়ন ও খেলাপি ঋণের তথ্য বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশ করার পদক্ষেপ নেওয়া। সেটির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নিচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমানোর শর্তও রয়েছে তাদের। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংককে ১০ শতাংশ ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের অনেক উপরে রয়েছে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী এ প্রক্রিয়াটি ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।
আগে মুদ্রানীতিতে খেলাপি ঋণ নিয়ে কোনো কথা বলত না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি থেকে খেলাপি ঋণ নিয়ে কড়া কাথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। এবারের মুদ্রানীতিতেও খেলাপি ঋণের বিষয়ে কড়া কথাবার্তা থাকবে।
মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের জন্য টাকার প্রবাহে লাগাম টানা হবে। তবে এখন যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে সেগুলো টাকার প্রবাহ বাড়ার কারণে হচ্ছে না। এগুলো হচ্ছে ডলারের দাম বৃদ্ধি, স্থানীয় বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে। ফলে মূল্যস্ফীতি এ মুদ্রানীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলার সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘ সময় ধরে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় আমদানি নির্ভর পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে। যে কারণে এখন সেগুলোর দাম বাড়ছে। এর প্রভাবে দেশীয় পণ্যের দামও বাড়ছে। ডলার সংকট মোকাবিলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলেও এখন এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়া শুরু করেছে। এ জন্য রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়াতে হবে। টাকার প্রবাহ কমিয়ে চাহিদায় লাগাম টানতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মুদ্রানীতি ব্যবহার করে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, এমন কি ভারত মূল্যস্ফীতির হারকে বাগে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ পারছে না। কারণ এখানে বাজারে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই।
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সংকুলানমুখী নীতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আইএমএফ চাচ্ছে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্বিকভাবে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি অনুসরণ করলেও উৎপাদন খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হবে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতির অনেক লক্ষ্যমাত্রাই এখনো অর্জিত হয়নি। তারমধ্যে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, জুনের তথ্যগুলো এলে মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন আরও স্পষ্ট হবে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে একটি বার্তা দেয়। সে অনুযায়ী বেসরকারি খাত পদক্ষেপ নিতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি কমায় বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি ২ হাজার ৯০ কোটি ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু এপ্রিল পর্যন্ত ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৩১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয়েছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। চলতি জুনের শেষে ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর কারণ হিসাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যসহ প্রায় সবকিছুর দাম কমেছে। এতে আমদানি ব্যয়ও কমেছে। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি ৬৮২ কোটি ডলারে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিলে ঘাটতি ৩৭৭ কোটি ডলার হয়েছে। এ খাতেও ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখার আশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আর্থিক হিসাবে গত অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল। চলতি অর্থবছরেও এ হিসাবে ২৮০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত রাখার লক্ষ্যছিল। তবে মার্চ পর্যন্ত এ হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ২২২ কোটি ডলার। এ হিসাবে ঘাটতি আরও বাড়তে পারে। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ সাড়ে ১৮ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিলে বেড়েছে ১১ দশমিক ০৭ শতাংশ। জুনের মধ্যেও এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, মন্দায় বাজারে চাহিদা না থাকায় ঋণ প্রবাহ বাড়েনি।
চলতি অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বছর শেষে এ খাতেও ঘাটতি থাকবে। ডলার সংকটে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সরকারি ঋণ বাড়েনি।
চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১৪ দশমিক ১ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জুলাই-এপ্রিলে বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এতেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। কারণ বেসরকারি খাত দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তায় ভুগছে।
ঊষার আলো-এসএ