UsharAlo logo
শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নগরায়ণের প্রভাবে মায়েরা কি সন্তান থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন

usharalodesk
মে ৬, ২০২১ ৫:০৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে সবখানে। গ্রামগুলো ধীরে ধীরে শহরের ধারণায় চলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন শুধু যে ইট–বালুর দালানে হচ্ছে সেটি নয়। পরিবর্তন আসছে জীবনযাপনেও। এ পরিবর্তন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আনছে শিশুর মানসিকতায়ও। এমনকি মায়ের ভূমিকাতেও এটি পরিবর্তন আনছে।

পূর্বে যে শিশু বিনোদনের জন্য সবুজ মাঠে দৌড়ে বেড়াত। খেলার মাধ্যম হিসেবে তুলে নিত ছোট্ট পুতুল কিংবা খেলনা গাড়ি। আজ সেই শিশু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিন।

শুধুমাত্র নগরায়ণ গৃহিণী মাকে কর্মজীবী মায়ে পরিণত করছে। আগে যে মায়ের চরিত্র বলতেই আমাদের চোখের সামনে একটি সাধারণ চিত্র ভেসে উঠত। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য নাশতা বানানো। তারপর দুপুরের রান্না করা। বিকেলে ছেলেমেয়ের সাথে খেলাধুলা আর সন্ধ্যায় তাদের পড়তে বসানো। কিন্তু সেই চিত্র ক্রমে অপস্রিয়মাণ। নগরায়ণের প্রভাবে সবকিছু যেন বদলে দিয়েছে। এখন সকালে নাশতা বানানোর পাশাপাশি কর্মজীবী মাকে যেতে হয় বাইরের কাজে। যার ফলস্বরূপ নগরায়ণ একদিকে মায়েদের কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। অন্যদিকে মাকে তাঁর সন্তানের থেকে কিছুটা দূরেও সরিয়ে দিচ্ছে।প্রতিবছরই মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। তাদের অধিকাংশেরই স্থান হয় ঢাকার বস্তিতে। ২০১৩ সালে পরিচালিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের তথ্য অনুসারে, ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার বস্তিতে ৪০ লাখ মানুষ বসবাস করছে। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই বসবাস করছে এক কক্ষে। ওইসব এলাকার শিশুদের জীবন মানবেতর। কাজের জন্য যখন মা–বাবা ২ জনই ঘরের বাইরে যান। ঠিক তখন শিশুটিকে একা থাকতে হয়। এমনকি অনেক সময় তাদের নানা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এসব শিশু উচ্চমাত্রার অপুষ্টি, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম এবং যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ঘটনাগুলোতে কোনো না কোনোভাবে মায়ের অনুপস্থিতির প্রভাব থেকে যাচ্ছে।

২০১৬ সালে পরিচালিত চাইল্ড ওয়েল রিং সার্ভে এবং এমআইসিএসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দেশের শহরে বস্তির শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ধীরে ধীরে গ্রামের শিশুদের চেয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর পেছনে বড় একটি কারণ হচ্ছে, মায়েদের থেকে দীর্ঘ সময় শিশুদের দূরে থাকা। একজন মা যখন কাজের জন্য বাইরে থাকেন। তখন তাঁর শিশুটি খাচ্ছে কি না তা তিনি খেয়াল রাখতে পারছেন না। আবার কাজের মধ্যেও তিনি বারবার হয়তো তাঁর শিশুর কথাই চিন্তা করতে থাকেন। ফলে কাজেও যথাযথ মনোযোগ দিতে পারেন না। এমনকি সারা দিন কাজের পর রাতে বাসায় ফেরার পরও সারা দিনের ক্লান্তি তাঁকে ঘিরে ধরে। ইচ্ছা করলেও তখন তাঁর প্রিয় সন্তানটির যথাযথ যত্ন নেওয়া সম্ভব হয় না। শহরের কলকারখানায় কাজ করা মায়েদের অবস্থা আরও শোচনীয়। চাকরির পাশাপাশি অভিভাবকের দায়িত্ব পালনেও তাঁদের হিমশিম খেতে হয়। সম্প্রতি ইউনিসেফের এক জরিপে অর্ধেকের বেশি নারী বলেছেন, তাঁরা মূলত কাজের জন্যই সন্তানের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। দ্রুত নগরায়ণ ও লোকজনের শহরমুখী হওয়া, তা স্বেচ্ছায় হোক বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাধ্য হয়েই হোক না কেন, দুটি বিষয়ই সন্তানের প্রতি মা–বাবার যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করছে। মায়েদের থেকে দূরে থাকায় শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় নীতিমালা তৈরি করেছে।

সমাজবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, গত ২ দশকে দ্রুত নগরায়ণের ফলে বাংলাদেশের পরিবারব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবছর ১৫ মে পালন করা হয় বিশ্ব পরিবার দিবস। সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সামিনা লুতফা বলছেন, ‘ভবিষ্যতে অন্য যেকোনো শিল্পোন্নত দেশের মতো আমরাও দেখতে পাব, একক মায়েদের সংখ্যা বেড়ে যাবে, তালাকপ্রাপ্ত অভিভাবকদের সংখ্যা বাড়বে। ফলে শিশুসন্তানদের দেখাশোনার দায়ভার যদি সমাজ বা রাষ্ট্র গ্রহণ না করে, তার প্রভাব সমাজের ওপর পড়বে। একসময় এই শিশুদের হয়তো দাদি-নানিরা দেখতেন। এখন আর সেগুলো পাওয়া যাবে না।’

ফলে, এসব কর্মজীবী মায়ের শিশুরা একদিকে মায়ের সাহচর্য থেকে দূরে থাকছে, অন্যদিকে পারিবারিক বন্ধনের মূলধারা থেকেও সরে আসছে। নগরায়ণ আমাদের মায়েদের কাজের সুবিধা যেমন করে দিচ্ছে, ঠিক অন্যদিকে মায়ের ভূমিকারও যথেষ্ট পরিবর্তন এনে দিচ্ছে। এ পরিবর্তন অনেকাংশেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের পিছিয়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সচেতন মহলসহ সরকারের নীতিমালায় শুধু বিষয়টিকে যুক্ত করার মাধ্যমেই ক্ষান্ত হলে চলবে না। নীতির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নীতিমালার সফল বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার জন্য বিনিয়োগ করা প্রয়োজন এবং তা করতে হবে বিভিন্ন খাতের সমন্বয় ও পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহের মধ্যমে। কাজের পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে প্রত্যেক কর্মজীবী মায়ের মাতৃত্বের সুযোগ। সূত্র-প্রথম আলো।

(ঊষার আলো-আরএম)