ঊষার আলো রিপোর্ট :আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রার নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব প্রকাশের পর ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। গ্রস রিজার্ভ ২৯৯৭ কোটি ডলার থেকে ৬৪০ কোটি বাদ দিয়ে ২৩৫৭ কোটি ডলারের নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নিট রিজার্ভ থেকে আরও প্রায় ৫০০ কোটি ডলার বিভিন্ন বিদেশি বন্ডে বা মুদ্রায় বিনিয়োগ করা আছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগও আছে।
একদিনের জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে অর্থ বিনিয়োগ করে। এসব বিনিয়োগ থেকে আয়ও করে। আবার মুদ্রার মান কমে গিয়ে বিনিয়োগ থেকে লোকসানের নজিরও আছে। এসব বিনিয়োগের একটি অংশ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য নয়। একটু সময় নিয়ে এগুলো নগদায়ন করতে হয়। এরপর এগুলো ব্যবহারযোগ্য হবে। এ হিসাবে প্রকৃত রিজার্ভ আরও কম। যা দিয়ে দুই মাসের তাৎক্ষণিক আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, আইএমএফের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বাভাবিক সময়ে কোনো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান থাকলে তাকে নিরাপদ ভাবা হয়। কিন্তু দেশটি বেশি মাত্রায় আমদানিনির্ভর ও খাদ্য আমদানি করলে কমপক্ষে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়।
এছাড়া অর্থনৈতিক সংকট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ হলে আরও বেশি রিজার্ভ রাখতে হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর একটি দেশ। রপ্তানি আয় দিয়ে ৬০ শতাংশ আমদানি ব্যয় মেটানো যায়। ফলে ৪০ শতাংশ বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। এ ঘাটতি মেটানো হয় রেমিট্যান্স দিয়ে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চিহ্নিত করে। এ কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের চেয়ে আরও বেশি থাকা প্রয়োজন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভ থেকে প্রধানত অর্থ ব্যয় হয় আমদানি খাতে ও বৈদেশিক ঋণ শোধে। কোনোটিই তাৎক্ষণিকভাবে শোধ করতে হয় না। সময় নিয়ে শোধ করার সুযোগ আছে। একই সঙ্গে মেয়াদ বাড়ানোরও সুযোগ আছে। ফলে রিজার্ভের কোনো অংশ দিয়েই তাৎক্ষণিক ব্যয় মেটানো হয় না।
এটি একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। ফলে রিজার্ভ থেকে অর্থ বিনিয়োগ করে আটকে ফেলা হয়েছে, এমনটি ভাবা ঠিক নয়। সব দেশই রিজার্ভের অর্থ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে। এতে মুনাফা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত অর্থবছরের মন্দার মধ্যেও ৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। যখন প্রয়োজন হবে বিনিয়োগ অর্থ তুলে আনা যাবে। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি সেভাবেই আছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিল গঠন ও বিভিন্ন খাতে ঋণ দিয়েছে। ওইসব অর্থও রিজার্ভে দেখাত। এ নিয়ে আইএমএফ আপত্তি তোলে ২০২১ সালে। ২০২২ সালে এটি ঋণের শর্ত হিসাবে আরোপ করে। এ কারণে শুরুতে ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিতে বলেছিল। এসব অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। এ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৬০ কোটি ডলার বাদ দেয়। এর মধ্যে ফলে রিজার্ভ থেকে নেওয়া অর্থ আবার কিছুটা ফেরত এনে ৬৪০ কোটি ডলার বাদ দিতে হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ৪৮০৬ কোটি ডলারে ওঠে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড। এর পর থেকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে থাকে। তখন থেকে রিজার্ভ কমতে থাকে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬১৫ কোটি ডলারে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ ছিল ৪৫৯৫ কোটি ডলার। ওই বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ বেড়েছিল।
কিন্তু ফেব্রুয়ারির পর থেকে রিজার্ভ আর স্থায়ীভাবে বাড়েনি। মার্চে তা কমে ৪৪১৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। জুনে আরও কমে ৪১৮৩ কোটি ডলার হয়। জুলাইয়ে তা আরও কমে ৩৯৬০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ওই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এই অবস্থায় রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে গত বছরের এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে এলসি মার্জিন আরোপ করে। পরে তা আরও বাড়ানো হয়। এখন ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ রয়েছে।
গত বছরের জুনের পর থেকে রিজার্ভ আরও কমতে থাকে। কারণ ওই সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে যায়। ফলে সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৬৪৮ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে তা আরও কমে ৩৩৭৭ কোটি ডলারে নামে। গত জুনে ৩১২০ কেটি ডলার ছিল। গত ১২ জুলাই আরও কমে ২৯৯৭ কোটি ডলারে নামে। ওই দিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করে। গ্রস রিজার্ভ থেকে ৬৪০ কোটি ডলার বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভ হয়েছে ২৩৫৭ কোটি ডলার।
ঊষার আলো-এসএ