ঊষার আলো রিপোর্ট : মূল্যবৃদ্ধির উত্তাল বাতাস বইছে নিত্যপণ্যের বাজারে। সর্বত্রই সিন্ডিকেটের থাবা। পণ্যমূল্য ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম আরও জোরদারের সুপারিশ আসছে সব জায়গা থেকে। লোকবল অভাব দেখিয়ে উলটোপথে হাঁটছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর।
তাদের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বার্ষিক কর্ম-পরিকল্পনায় নিত্যপণ্যের বাজার মনিটরিংয়ের আওতা সংকুচিত করেছে মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে তালমিলিয়ে হাঁটছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। গত বছর ৭৫৯ বাজার পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়।
এবার তা কমিয়ে ২৫০তে নামানো হয়। পয়লা জুলাই থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। বাজার মনিটরিং থেকে কিছুটা সরে আসার কারণে সিন্ডিকেট আরও সক্রিয় হতে পারে এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যা সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য আরেক দফা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
মনিটরিং কার্যক্রম ছাড়াও নয়টি অতিনিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেঁধে দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্ম-পরিকল্পনার (২০২৩-২৪) নথিতে দেখা গেছে, মনিটরিং কর্মসূচির আওতায় সারা বছর নিত্যপণ্যের বাজার পরিদর্শনের সংখ্যা ৭৫৯টি থেকে কমিয়ে ২৫০টি নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় পরিদর্শনের সংখ্যা কমছে ৫০৯টি।
আর জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর গত অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৮৫টি বাজার তদারকি করলেও চলতি অর্থবছরে তা ১০ হাজারে আনা হয়। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বাজার পরিদর্শন কমবে এক হাজার ৭৮৫টি। ইতোমধ্যে এই পরিকল্পনা নিয়ে মাঠ কাজ শুরু করেছে মন্ত্রণালয় ও সংস্থা দুটি।
কারণ জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে জানান, প্রতিদিন বাজার পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করতে জনবল প্রয়োজন।
সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে গেলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অন্য কোনো কাজ করতে পারবে না। যে কারণে এই মনিটরিং কার্যক্রম কমিয়ে আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ের বাইরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থা মনিটরিং কাজটি করছে। এসব সংস্থা সঠিকভাবে করছে কিনা তা কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করছি আমরা।
সূত্র আরও জানায়, মন্ত্রণালয়ের কর্ম-পরিকল্পনার মধ্যে চলতি অর্থবছরে কয়েকটি চ্যালেঞ্জকে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল, আমদানি করা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলা এবং সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক রাখা। সেখানে আরও বলা হয়, নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে বিগত ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩১ হাজার ৯২৩টি বাজারে অভিযান চালানো হয়।
এ সময় ৫২ হাজার ৩৯০টি অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু এতগুলো অভিযান পরিচালনার পরও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হচ্ছে। সেখানে এই তদারকি কমিয়ে দেওয়া হলে বাজারে সিন্ডিকেট আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞমহল।
২০২২ সালের ৩০ আগস্ট সচিবালয়ে দ্রব্যমূল্য-সংক্রান্ত বৈঠকে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে দেশের অতিপ্রয়োজনীয় নয়টি পণ্যের দাম নির্ধারণের ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। নির্ধারিত ওই নয়টি পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, ডিম, রড ও সিমেন্ট। গমের মধ্যে আটা ও ময়দা, ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েল ও সয়াবিন দুই ধরনের পণ্যই রয়েছে। তবে ওই ঘোষণা বাস্তবায়নে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ফলে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে কমেনি বরং কিছু পণ্যে দাম উলটো বেড়েছে। ডলার সংকট, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ওঠানামা, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ বৈশ্বিক সংকট প্রভাবের কথা বলে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলা হয়েছে। তবে এ ধরনের প্রভাবে যতটা মূল্য বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে সিন্ডিকেটের থাবায়। শুধু এক ডিমের বাজার ঘিরে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বাজারে অভিযান চালিয়েও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি খারাপ দেখে সোমবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, রশিদ ছাড়া ডিম বেচাকেনা হলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে। শুধু ডিম নয়, সবজি, মাছ, মাংস, চিনি, ভোজ্যতেলসহ অধিক প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের বাজারে এক ধরনে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত ৪ আগস্টের ফোরকাষ্টে দেখা গেছে, গত জুলাই মাসে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম গড়ে দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। পনের দিনের ব্যবধানে প্রতিটন চিনির দাম গড়ে ১০ ডলার কমেছে।
পহেলা আগস্ট প্রতিটন চিনির মূল্য ছিল ৬৯৩ ডলার। এটি ৬৭৩ ডলার পর্যন্ত মূল্য কমে এই সময়ে। আর সর্বশেষ ১৪ আগস্ট মঙ্গলবার দেখা গেছে, প্রতিটন চিনির মূল্য ৬৮৭ ডলার। জুলাইতে চিনির মূল্য কমেছে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে এ সময় ভোজ্যতেলের মূল্য ১২ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে।
বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের গড় মূল্য কমতে শুরু করলেও এর প্রভাব তেমন বাজারে পড়ছে না। এ জন্য কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, বাজার মনিটরিং দরকার আছে। সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, মনিটরিংয়ের জন্য সরকার জনবল ব্যবস্থা করবে। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
এদিকে বাজারে কমবেশি অভিযানে যাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। কিন্তু এই সংস্থার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে চলতি অর্থবছরে ১০ হাজার সচেতনতামূলক সভা ও গণশুনানি, ১০ হাজার বাজার পরিদর্শনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু আগের অর্থবছরের পরিকল্পনায় এসব উদ্যোগ আরও বেশি ছিল।
কর্ম-পরিকল্পনায় এই সংস্থা চ্যালেঞ্জ হিসাবে কয়েকটি বিষয়কে শনাক্ত করেছে।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাজার তদারকিতে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন ও অবহিতকরণকে চ্যালেঞ্চ হিসাবে দেখছে।
ঊষার আলো-এসএ