ঊষার আলো রিপোর্ট: আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার ডলার, ঋণের সুদহার, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়িয়েছে। এগুলোর প্রভাবে লাগামহীনভাবে বেড়েছে গণপরিবহণসহ বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম। বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। ফলে ওই সব খাতেও পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছে। ফলে বাড়েনি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার কমানো সম্ভবই হয়নি, উলটো এর পালে আরও হাওয়া লেগেছে। মানুষের খরচ বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি আয়। ফলে জীবনযাত্রার মান কমেছে। এসব মিলে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আইএমএফের শর্তের জ্বালায় জ্বলছে ভোক্তা।
সূত্র জানায়, বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে ঋণের দুটি কিস্তি ছাড় হয়েছে। তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে আইএমএফ মিশনের সঙ্গে সরকারের দর কষাকষি শেষ হয়েছে। ২৪ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত আইএমএফ মিশন বাংলাদেশে কাজ করেছে। ওই সময়ে তারা বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমের জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। এ মিশনের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি। তবে ঢাকা ত্যাগের আগে মিশনটি প্রায় নিশ্চিত করেছে ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার বাংলাদেশ পাচ্ছে। চলতি মাসের শেষ দিকে বা আগামী মাসের প্রথম দিকেই এ অর্থ ছাড় করবে আইএমএফ।
মন্দার প্রভাব মোকাবিলার জন্য গত বছরের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশের অনুকূলে আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। ওই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৮ কোটি ডলার ছাড় করে। গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ডলার ছাড় করে। আইএমএফের ঋণ নেওয়ার আলোচনা শুরুর আগেই সরকার ২০২২ সালে জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। এর প্রভাবে ওই সময়ে গণপরিবহণের ভাড়া মাঠপর্যায়ে বৃদ্ধি পায় প্রায় শতভাগ। একই সময়ে বাড়ে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। ওই বছরেই সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়।
আইএমএফ বিষয়টি ইতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করে ঋণের প্রস্তাবে দ্রুত সাড়া দেয়। এখন পর্যন্ত আইএমএফের বেশিরভাগ শর্তই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এর মধ্যে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছু শর্ত বাস্তবায়নের কারণে বাজারের আগুনের তেজ আরও বেড়েছে। এতে জ্বলছে ভোক্তা।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের ক্রলিং পেগ পদ্ধতি (একটি নির্দিষ্ট সীমায় রেখে ডলারের দাম ওঠানামা) চালু করে। ফলে ওই দিনই ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম এক লাফে ৮ টাকা বেড়ে ১১০ টাকা থেকে ১১৮ টাকায় ওঠে। এটি রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের জন্য কিছুটা ইতিবাচক হলেও আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক দেনার পরিমাণ বেড়ে যাবে। টাকার মান কমায় মূল্যস্ফীতিতে চাপ আরও বাড়বে। ফলে ভোক্তা আরও বেশি চাপে পড়বে। একদিনে খোলা বাজারে ডলারের দাম ১১৭ থেকে ৮ টাকা বেড়ে ১২৫ টাকা হয়েছে।
শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এর আগেও ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে, কমানো হয়েছে টাকার মান। গত দুই বছরে ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৮ টাকা হয়েছে। তবে ওই দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। রপ্তানিকারক ছাড়া অন্য আমদানিকারকদের এলসি খোলার আগে ডলার কিনতে হয়। আগাম ডলারের দাম বেড়ে এখন বিভিন্ন মেয়াদের জন্য ১২৫ থেকে ১২৯ টাকায় নেওয়া হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ব্যবহারের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে টাকার প্রবাহ কমানো ও ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। টাকার প্রবাহ কমানোর ফলে বিনিয়োগ কমে গেছে। নতুন শিল্প স্থাপনের গতি মন্থর হয়েছে। কর্মসংস্থান বাড়ার হার কমেছে। শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য খাতে প্রতিযোগিতা কমায় উৎপাদন কমেছে, বেড়েছে দাম। শর্ত বাস্তবায়ন করতে জুলাইয়ে ঋণের সুদহারের একটি করিডর ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আওতায় সুদহার বেড়েছে। এতে ব্যবসা খরচ বাড়ায় ঋণের প্রবাহে লাগাম পড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়ায় পণ্যের দাম বেড়েছে। এক বছর আগে ঋণের সুদ ছিল সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশের বেশি। সরকারি খাতের ট্রেজারি বিলের সুদ ৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ শতাংশ। এতে সরকারি ঋণের খরচ বেড়েছে। ফলে সরকারকে বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে পুরো আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে চাপে ফেলেছে। এই অর্থ সরকার জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে আদায় করছে। অবস্থা ভালোর চেয়ে খারাপের দিকে যাওয়ায় সুদ হার করিডর চালুর ৯ মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা থেকে সরে আসছে। জুলাই থেকে প্রতি মাসের শেষ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার প্রকাশ করছে। এর ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। ফলে প্রতি মাসেই সুদ বেড়েছে। আগাম ঘোষণা দিয়ে সুদহারের করিডর চালু করা হয়েছিল। এখন কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই বুধবার থেকে এ ব্যবস্থা থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ঋণের সুদহার আরও কিছুটা বাড়বে। এটি আগামী মাস থেকেই কার্যকর হবে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অথচ জিডিপিতে এ দুই খাতই সবচেয়ে বড় অবদান রাখে। এ দুই খাতে টাকার জোগান কমানোর কারণে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান দুটিই কমেছে। শুধু মুদ্রানীতির প্রয়োগের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারে পণ্যের দাম বাড়ানোর নেপথ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
সূত্র জানায়, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার বিভিন্ন পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়াতে বা কমাতে হবে। এটি বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম সামান্য পরিমাণে কমানো ও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাজারে এর কোন প্রভাব নেই। কিন্তু আগে যে এক সঙ্গে বড় আকারে বাড়ানো হয়েছে তার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। সার, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম।
সরকার স্বল্প আয়ের মানুষকে সহায়তা করতে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে সরকার ভর্তুকি কমাচ্ছে। এটি করতে গিয়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কম দামে পণ্য বিতরণের ক্ষেত্রেও মূল্য বাড়াতে হয়েছে। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা কমেছে।
আইএমএফের অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে কর আদায় বাড়ানো। এ লক্ষ্যে গত বাজেটে রাজস্ব আয় জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি করতে গিয়ে ভোক্তার ওপর করের বোঝা চাপানো হয়েছে। আগামী বাজেটে কর ছাড় তুলে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এটি করলে মানুষের ওপর করের বোঝা আরও বাড়বে।
২০২১ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ। গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ঋণ ছাড়ের সময় আইএমএফ বলেছিল, এ ঋণ মূল্যস্ফীতি ও বাজারে পণ্যের দাম কমাতে সহায়তা করবে। বাস্তবে পণ্যমূল্য কমেনি, উলটো বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কমে এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে।
আইএমএফ থেকে ঋণের দুটি কিস্তি বাবদ পাওয়া গেছে ১১৬ কোটি ডলার। এতে দেশে ডলার সংকটের কোন উন্নতি হয়নি। সংকট রয়েই গেছে। মূল্যস্ফীতির হার, বাজারে পণ্যমূল্য কমেনি। অর্থনৈতিক মন্দায় রাজস্ব আয় বাড়েনি। কিন্তু তাদের শর্ত বাস্তবায়নের প্রভাবে বাজারে সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। তারা ভর্তুকি কমাতে এগুলোর দাম আরও বাড়াতে চাপ দিচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে দাম আরও বাড়বে। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে আরও বেশি জ্বলবে ভোক্তা।
ঊষার আলো-এসএ