ঊষার আলো রিপোর্ট : সাত জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে আন্দোলনে নেতাদের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিএনপি। সেই প্রতিবেদন ধরে শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে দলটি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ও আন্দোলনে ব্যর্থ নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন কমিটিতে অপেক্ষাকৃত তরুণদের প্রাধান্য দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলের আস্থাভাজন ও আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে ভূমিকা রাখতে সক্ষম এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন নেতাদের নতুন কমিটিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একযোগে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগরের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। শিগগিরই এসব সাংগঠনিক জেলার কমিটি দেওয়া হবে। এছাড়াও ঢাকা ও গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতি পদ পরিবর্তনের গুঞ্জন রয়েছে। ভেঙে দেওয়া হতে পারে খুলনা, কুমিল্লা ও গাজীপুর মহানগরসহ আরও অন্তত সাতটি জেলা কমিটি। এদিকে বিলুপ্ত যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও যে কোনো সময় দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ঘোষণার কথা রয়েছে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিও। এরপর পর্যায়ক্রমে মেয়াদোত্তীর্ণ মহিলা দল, জাসাস, তাঁতীদল, মৎস্যজীবী দল ও শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ারও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
বিগত আন্দোলন পরিচালনা ও দল পুনর্গঠনের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাজপথের আন্দোলনে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের কার কী সফলতা-ব্যর্থতা ছিল, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ওই প্রতিবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পর দল পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। যদিও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘কমিটি গঠন একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়া; এর বেশি কিছু নয়। তবে বরাবরের মতো কমিটি গঠনে এবারও যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করবে দল।’
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতাসংক্রান্ত দলের প্রতিবেদনকে অনুসরণ করে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, সারা দেশের জেলা ও মহানগর কমিটি এবং কেন্দ্রীয় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিসংক্রান্ত কাজ শুরু করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই সময়ে কৌশলে তারেক রহমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও করেছেন।
এদিকে সবশেষে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার ভার্চুয়ালি পৃথক বৈঠক করেন তারেক রহমান। সেখানেই নেতাদের নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তাকে সহযোগিতা করার নির্দেশনা দেন। বিএনপির চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর কমিটি গঠনের কথা আগেই জানিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ চার মহানগর কমিটি ও কেন্দ্রীয় যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করার আগে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কথা বলে নেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় নতুন কমিটি করার লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, বরিশাল মহানগর বিএনপি এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।
বিএনপির ৮২ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে সাতটির মতো কমিটির মেয়াদ আছে, বাকিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। নেতারা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের প্রায় আড়াই মাসের আন্দোলনে অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ নেতাদের মাঠে পাওয়া যায়নি। অথচ অনেক জেলা আছে সেখানে পদবিহীন নেতারা আন্দোলন করেছেন। শীর্ষ পদ নিয়ে দলের দুঃসময়ে পাওয়া যাবে না তা হতে পারে না। আন্দোলনে-সংগ্রামে যারা ছিলেন, তাদের দিয়ে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটি করা উচিত।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি থাকলে ভেঙে নতুন কমিটি করা হবে। যেসব কমিটির মেয়াদ আছে; কিন্তু সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক বিগত আন্দোলনের মাঠে ছিলেন না, তাদের কমিটি থেকে সরিয়ে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এ ধরনেরও একটি তালিকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া হয়েছে। সূত্রমতে, এ তালিকায় ঢাকা ও গাজীপুর জেলা রয়েছে। ঢাকা জেলা কমিটি থেকে সভাপতিকে বাদ নিয়ে নতুন সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে ডা. দেওয়ান সালাহউদ্দিন বাবুকে। তিনি ঢাকা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ছিলেন। একইভাবে গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতিকে সরিয়ে বর্তমান সাধারণ সম্পাদককে সভাপতি ও বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার চৌধুরী ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকীকে সাধারণ সম্পাদক করা হতে পারে। ইশরাক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর ছেলে। এছাড়াও গাজীপুর, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী মহানগরসহ আরও অন্তত সাতটি সাংগঠনিক জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। পর্যায়ক্রমে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল, জাসাস, তাঁতীদল, মৎস্যজীবী দল ও শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিও ভেঙে দেওয়ারও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
ঢাকা মহানগর উত্তরে শীর্ষ পদে আলোচনায় যারা : নতুন কমিটির শীর্ষ পদে যাদের নাম আলোচনায় আছে তারা হলেন- বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সদ্য বিদায়ি মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক, বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহ-সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, সদ্য বিদায়ি যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর প্রমুখ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব নেতার সঙ্গে গত এক মাসের মধ্যে এ নিয়ে কথাও বলেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণে আলোচনায় যারা : দক্ষিণে নতুন কমিটির শীর্ষ পদে যাদের নাম আলোচনায় আছে তারা হলেন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হামিদুর রহমান হামিদ, হাবিবুর রশিদ হাবিব, সদ্য বিদায়ি মহানগর দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিন, সিনিয়র সদস্য প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন প্রমুখ।
চট্টগ্রাম মহানগরে আলোচনায় যারা : এ মহানগরে নতুন কমিটিতে যাদের নাম আলোচনায় আছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সদ্য বিদায়ি কমিটির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন, সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ আজিজ, এসএম সাইফুল ইসলাম, নাজিমুর রহমান, সদস্য এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন দিপ্তীসহ ডজনখানেক নেতা।
বরিশাল মহানগরে আলোচনায় যারা : এ সাংগঠনিক জেলার নতুন কমিটিতে শীর্ষ পদে যাদের নাম আলোচনায় রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, সদ্য বিদায়ি কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউদ্দিন শিকদার, সদস্য আফরোজা খানম নাসরীন, বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবায়েদুল হক চাঁন, সাবেক আহ্বায়ক মজিবুর রহমান নান্টুসহ ডজনখানেক নেতা। এর মধ্যে গত আন্দোলনে আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, জিয়াউদ্দিন শিকদার ও আফরোজা খানম নাসরীন রাজপথে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন। কারাগারে ছিলেন মনিরুজ্জামান ফারুক, তিনিও ত্যাগী নেতা। তবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারকেও চায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ। তাদের মতে, বিএনপির রাজনীতিতে পুরো বরিশাল অঞ্চল এখন অভিভাবকশূন্য। মহানগরের সাবেক সভাপতি সরোয়ারকে আবারও সভাপতি বা আহ্বায়ক করা হলে নেতাকর্মীরা বরিশাল অঞ্চলে একজন অভিভাবক পাবেন। এ অঞ্চলে হারানো শক্তি ফিরে পাবে নেতাকর্মীরা।
যুবদলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ পদে আলোচনায় যারা : যুবদলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ পদে যাদের নাম আলোচনায় আছে তারা হলেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম মুন্না, সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন, সাবেক নেতা এসএম জাহাঙ্গীর, সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, গোলাম মাওলা শাহীন, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, সদস্য সাঈদ ইকবাল টিটু (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদার)। শীর্ষ পদে বিশেষভাবে আলোচনায় আছেন-ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান মিন্টু, সাবেক সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ। এসব নেতার সঙ্গেও বিভিন্ন সময়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কথা বলেছেন।
ঊষার আলো-এসএ