ঊষার আলো রিপোর্ট : মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন, তখন দেশের স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মো. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।
এই নেতারা প্রবাসী সরকারের অধীনে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের কাজ করেন। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে, তবুও তাকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে তারা একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তাদের নেতৃত্ব ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সফলতা সম্ভব ছিল না।
তবে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই চার নেতার অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতিহাসবিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বারবার উল্লেখ করেছেন যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তারা প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
‘প্রবাসী সরকারের স্তম্ভ চার জন না, ছয় জন’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইতিহাস নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ।এই প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘মুজিবনগর সরকারের স্তম্ভ চার জন না, ছিলেন ছয় জন।’
তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী, এই দু’জনের নাম এই তালিকায় যুক্ত করেন তিনি।
এই লেখকের মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তারা প্রত্যেকে ‘শেখ মুজিবের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেলেন।’
‘এটা তো আওয়ামী লীগের সরকার ছিল এবং শেখ মুজিব ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। এরকম একটি ধারণা তৈরি করানো হলো যে তিনিই দেশ স্বাধীন করেছেন। অন্যদের ভূমিকা চাপা পড়ে গেল।’
আহমদ তার আলোচনা এখান থেকে আরও তিন বছর এগিয়ে নিলেন এবার।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে হত্যা হলেন এবং ‘শেখ মুজিব সরকারের পতন হল।’
‘তারপর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সরকার গঠন হলো। তখন আওয়ামী লীগের বলয়ে খন্দকার মোশতাক হয়ে গেলেন ভিলেন… সেসময় ওই সরকারের সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন এমএজি ওসমানী। তখন থেকে এই দুইজন ওই বয়ান থেকে বাদ পড়ে গেলেন।’
খন্দকার মোশতাক এবং এম এ জি ওসমানী’র কথা আপাতত এই আলোচনা থেকে বাদ দিলে বাকি যে চার নেতা, শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যখন অনেকটা দিশেহারা, তখন তাদেরকে বন্দী করা হয়।
শেখ মুজিব হত্যার প্রায় আড়াই মাস পর, ১৯৭৫ সালের তেসরা নভেম্বর ওই চারজনকেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।
পরবর্তীতে, দল হিসাবে আওয়ামী লীগ ওই দিনটিকে জেল হত্যা দিবস পালন করে আসছে।
আওয়ামী লীগ ও চার নেতার পরিবার
বারবার যেহেতু এখানে অবহেলা, উদাসীনতা বা অবমূল্যায়নের কথা আসছে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উঠছে যে চার নেতাকে কী ধরনের মূল্যায়ন করা যেতে পারতো।
মূল্যায়ন মানে কী আসলে?
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তাজউদ্দীন আহমেদের ছেলে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ একসময় আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমেদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সোহেল তাজ পদত্যাগ করার পরে তাজউদ্দীন আহমেদের আরেক সন্তান সিমিন হোসেন রিমি ওই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক সময়ের মন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদকও।
এ এইচ এম কামরুজ্জামানের বড় ছেলে এ এইচ এম খাইরুজ্জামান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র।
মো. মনসুর আলীর বড় ছেলে মোহাম্মদ নাসিম আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ছিলেন। ছোট ছেলে মোহাম্মদ সেলিমও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ছিলেন।
সুতরাং, এখানে দেখা যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনীতির ইতিহাসে জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যরা কোনও না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে।
তারপরও কেন চার নেতাকে অবমূল্যায়নের কথা আসে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে বলেন, ‘তাদেরকে (চার নেতাকে) মূল্যায়ন করা হয় না। এখানে যেটা হয়েছে, একজনের ছেলেকে মেয়র করেছে, একজনের ছেলেকে এমপি করেছে, একজনের ছেলেকে প্রতিমন্ত্রী করেছে, একজনের ছেলেকে মন্ত্রী করেছে। কিন্তু এগুলো হল সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো।’
‘তারা তো এটা দল করেই হয়েছে। এই নেতাদের সন্তান না হয়েও তো অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন। তাই না? কাজেই, তাদেরকে এখানে খুব বেশি ফেভার করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না,’ বলছিলেন তিনি।
এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমেদের মেয়ে শারমীন আহমেদ কথা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন, ‘ধরেন, ভাসানী পরিবার ক্ষমতার ভাগীদার হল। কিন্তু ভাসানীর নাম উঠিয়ে দেওয়া হল। তাতে কি ইতিহাসের প্রতি বা ভাসানীর মতো একজন মহান নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হল?’
‘তেমনি, (আওয়ামী লীগ) তাদেরকে (চার নেতার পরিবারের সদস্যদেরকে) সরকারি পদ দিয়েছে, কিন্তু নেতারা স্বীকৃতি তো পাননি। সুতরাং, তাদের অবমূল্যায়ন অবশ্যই হয়েছে।’
ঊষার আলো-এসএ