ঊষার আলো রিপোর্ট : আওয়ামী লীগ সিন্ডিকেটের সুপারিশে এখনো রমরমা নিয়োগ বাণিজ্য চলছে খুলনা বিভাগের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে সিন্ডিকেটে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পরও দুই দফা সভা করে নিয়োগ অনুমোদন করা হয়েছে ১৫ জনের। সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ সিন্ডিকেটে পরিবর্তন হলেও খুলনার শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যেন অঘোষিত আওয়ামী সাম্রাজ্য। যেখানে সাংবাদিক প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তথ্য পেতে সৃষ্টি করা হয় পদে পদে বাধা।
আওয়ামী পরিবারের পুনর্বাসন : উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আওয়ামী লীগের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। উপাচার্য মাহবুবুর রহমানের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। তিনি সম্পর্কে খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আলী আকবর টিপুর মামা। এসব পরিচয়ই তিনি উপাচার্য হওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগান। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ২৭ আগস্ট হঠাৎ করে সিন্ডিকেট সভা ডাকেন উপাচার্য। সভায় সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগের বিষয়টি তিনি অনুমোদন করিয়ে নেন। সিন্ডিকেট সভা অনলাইনে হলেও অধিকাংশ সদস্য এতে উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ এ নিয়োগের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও উপাচার্য তা আমলে নেননি। নিয়োগের তালিকায় আছেন খুলনা-২ আসনের সংসদ-সদস্য শেখ সালাউদ্দিন জুয়েলের শ্যালিকার ছেলে ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, তার ব্যক্তিগত সহকারীর স্ত্রী, সাবেক প্যানেল মেয়রের ভাগিনা ও ভাতিজা। এর বাইরে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রধান যোগ্যতা ছিল তারা আওয়ামী পরিবারের সদস্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়োগের ক্ষেত্রে পছন্দের প্রার্থীদের মনোনীত করতে উপাচার্য নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন, প্রার্থীদের খাতার মূল্যায়ন করতেন। কোন পদে কাকে নেওয়া হবে, তা তিনিই চূড়ান্ত করতেন। পছন্দের প্রার্থীদের আগে থেকে প্রশ্ন জানিয়ে দেওয়া ও লিখিত পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ও ছিল। ভাইভা বোর্ডে যারা থাকতেন, তারাও উপাচার্যের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতেন না। এ উপাচার্যের সময়ে যে নিয়োগ হয়েছে, সেখানে পারিবারিক সিন্ডিকেট, স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়োগ-বাণিজ্য, দলীয়করণ-সবই হয়েছে।
জানা যায়, ২৭ আগস্ট ১০ম সভায় যাদের নিয়োগ অনুমোদন করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে কেএম রব্বানীসহ ৪ জন যোগদান না করায় ৩ ডিসেম্বর আবারও ১১তম সিন্ডিকেটের সভা ডেকে তার স্থানে নতুন নিয়োগ অনুমোদন দেন উপাচার্য। রেজিস্ট্রার পদে কেএম গোলাম রব্বানীর পরিবর্তে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রভাবশালী আওয়ামী পরিবারের সদস্য আবু নাসের ফারুককে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহাজালাল সুজনের চাচাতো ভাই যোগদান না করায় তার পরিবর্তে নিয়োগ দেওয়া হয় শারমীন আক্তার নামে একজনকে। অফিস সহকারী ও কম্পিউটার টাইপিস্ট পদে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতির ছেলে হাসিবুর রহমান যোগ না দিলে সেখানে উদয় বালা নামে একজনকে নিয়োগ অনুমোদন করা হয়। এছাড়া অফিস সহায়ক পদে ইমামুল ইসলাম যোগদান না করায় তার স্থলে যোগদান করেন আত্ম প্রত্যয় মল্লিক।
এর আগে ২০২২ সালের ৪ আগস্ট প্রথমবার ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়। তখন যাদের চাকরি হয়, তাদের মধ্যে ছিলেন সেকশন অফিসার শেখ আশিক আহম্মেদ কাইয়ুম; তিনি সাবেক সংসদ-সদস্য শেখ সালাউদ্দিন জুয়েলের বড় শ্যালিকার ছেলে। জুয়েলের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় অনিক ইসলামের চাকরিও তখন হয়েছিল। সহকারী প্রোগ্রামার মোস্তফা রাকিব রায়হান ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আলী আকবর টিপুর ভাগিনা।
খুলনার নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে সবাই আশা করেছিলাম। এখনো যদি দুর্নীতি, লুটপাট, নিয়োগ-বাণিজ্য হয়; তাহলে এত প্রাণ, এত রক্ত বৃথা যাবে। সরকারের উচিত অবিলম্বে পতিত সরকারের দুর্নীতিবাজদের অপসরাণ করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে এমন ব্যক্তিদের দিয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে পুনরায় স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে দারোয়ান ৪০ মিনিট গেটে দাঁড় করিয়ে রাখেন। পরে প্রবেশের অনুমতি দিলে উপাচার্যের একান্ত সচিব ও নিকটাত্মীয় নুরুল মোমেন সব প্রশ্ন লিখে দিতে বলেন। এরপর প্রশ্ন লেখার মাঝখানে বলেন, তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। ভিসি স্যার ব্যস্ত আছেন, এখন দেখা করতে পারবেন না। পরে মোবাইল ফোনে উপাচার্যের কাছে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সব প্রক্রিয়াই বিধি মোতাবেক সিন্ডিকেটে উত্থাপন করেই হয়েছে। এখন ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলব।’
ঊষার আলো-এসএ