মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ প্ল্যান বা পালটা শুল্ক এবং ২০২৬ সালে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) উত্তরণ-এ দুটি বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের সামনে আগামী দিনে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
রাজধানীর গুলশান ক্লাবে শনিবার বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন।
‘বাংলাদেশের রপ্তানিতে আমেরিকার শুল্কারোপ : পারস্পরিক কৌশল এবং আলোচনার ভবিষ্যৎ পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ।
স্বাগত বক্তব্যে শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের পালটা শুল্ক ও এলডিসি উত্তরণ নিয়ে ব্যবসায়ীমহল চিন্তিত। বাংলাদেশ যেহেতু আমেরিকার প্রধান তুলা আমদানিকারক দেশ, সেহেতু আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারকে কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে এ ধরনের সুবিধা দিয়েছে। এসব বিষয়ে এখনই আলোচনা শুরু না করলে ভবিষ্যতে রপ্তানিমুখী শিল্প সমস্যায় পড়তে পারে।
মূল প্রবন্ধে ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের বিষয়ে ভারত ও ভিয়েতনাম গত নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে। ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) অনেক দূর এগিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ট্রাম্প প্রশাসন পালটা শুল্ক স্থগিত করায় সমস্যার সমাধান হয়নি, এখনো রয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, পালটা শুল্কারোপ শুধু ইকোনমিক বা ট্রেড ইস্যু নয়, এটি ভ‚-অর্থনৈতিক ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্র এ শুল্কারোপের মাধ্যমে কী চায়, তা বুঝে কৌশলগত অফার করতে হবে। যেমন : যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়াতে ফ্রি-জোন সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের সাপ্লাই চেইনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের পালটা শুল্কে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতগুলোর খাতভিত্তিক প্রভাব বিশ্লেষণ এবং কর্মসংস্থানে তা কী ভ‚মিকা রাখবে, তা নির্ণয় করতে হবে।
ওষুধ শিল্প সমিতির এম মহিবুজ্জামান বলেন, পালটা শুল্কারোপে ওষুধ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে এলডিসি উত্তরণ হলে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ওষুধের দাম ৩-৪ গুণ বেড়ে যেতে পারে। মেধাস্বত্ব ও পেটেন্টের কারণে নতুন ওষুধও বাজারে আনা যাবে না।
বিজিএমইএ প্রশাসক আনোয়ার হোসেন বলেন, পালটা শুল্কারোপ শুধু ট্রেড ইস্যু নয়। এ সমস্যা ক‚টনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তবে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে শ্রম কমপ্লায়েন্স, পরিবেশের দিকে নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি আমেরিকার বাজারে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা নিশ্চিতে টিকফা চুক্তির আলোচনা দ্রুত শেষ করতে হবে।
প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, চীনের পালটা শুল্ক স্থগিত না করায় বাংলাদেশের প্লাস্টিক খাতের বড় সুযোগ তৈরি করেছে। ডিজাইন ও ক্যাপাসিটি উন্নয়নের মাধ্যমে এ সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে মেধাস্বত্ব ও পেটেন্ট আইনের কারণে সমস্যায়ও পড়তে হবে এ শিল্পকে।
বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি (বিসিআই) আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ট্রাম্পের ট্যারিফ পুরো পৃথিবীতে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কার্যত তিনি বিশ্বায়নের কনসেপ্টকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে এখনো বিশ্বের কোনো দেশের জন্য এফটিএ বা পিটিএ করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে এলডিসি উত্তরণ করলে ট্যারিফ যৌক্তিক্করণের কারণে দেশে শিল্প থাকবে না। আমদানি পণ্য সস্তা হয়ে যাবে। তাই শিল্পের স্বার্থে এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে এলডিসি উত্তরণ ৩ বছর পেছানো দরকার।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, ৩৭ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ট্রেড করা সম্ভব নয়। এটা অবাস্তব পরিস্থিতি। এই শুল্কারোপের পেছনে ট্রাম্পের অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। ট্রেড গ্যাপ কমানোর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমেরিকান বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত নেওয়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন তিনি। রপ্তানিতে এটা আমাদের জন্য ‘শাপে বর’ হতে পারে। আমেরিকা ও আঞ্চলিক জেটগুলোর সঙ্গে এফটিএ করার মাধ্যমে রপ্তানি আরও বাড়ানো যেতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, পালটা শুল্কারোপে আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। টিকফার মতো আলোচনা জোরদার করা দরকার। পালটা শুল্কারোপের চেয়ে এলডিসি উত্তরণ নিয়ে বেশি আলোচনা হওয়া দরকার।
কারণ, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্র্তী সময়ে বাংলাদেশকে যেমন শ্রম আইন, পরিবেশ, মেধাস্বত্ব ও পেটেন্ট আইনের মতো আন্তর্জাতিক বিধিবিধানগুলো পরিপালন করতে হবে, তেমনই প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে জ্বালানি সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।
ঊষার আলো-এসএ