নাসির উদ্দিন : মো. নাজিম উদ্দিন সিরাজগঞ্জ জেলার এক স্বনামধন্য পরিবারের বড় ছেলে। এলাকায় ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তার। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও ভালো সখ্যতা ছিল তার। কয়েক বছর আগে একটা জরুরি কাজে প্রাইভেট কারে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটায় তার স্ত্রী মারা যায়, তার একমাত্র ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায় এবং নিজে প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করে। এখন হুইল চেয়ারই তার একমাত্র সম্বল। অনেক টাকা পয়সা খরচ করেও ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে পারেননি এবং নিজেও সুস্থ হতে পারেন নি। সড়ক দুর্ঘটনায় তার সাজানো সংসার ওলোট পালোট হয়ে গেছে। এখন আর কেউ তার খোঁজ খবর নেয় না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে, ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং বাকি ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।
সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে মিলে সর্বমোট ২৭৩টি দুর্ঘটনায় ৩০৪ নিহত এবং ৪৯২ জন আহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে নারী ৫৭ জন্য এবং শিশু ৩৮ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১০৮ টি (৩৯.৫৬%) জাতীয় মহাসড়কে, ৬৯টি (২৫.২৭%) আঞ্চলিক সড়কে, ৫৪ টি (১৯.৭৮%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৪২টি (১৫.৩৮%) শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৭৮ টি দুর্ঘটনায় নিহত ৮৩ জন। সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে। ২০টি দুর্ঘটনায় নিহত ২২ জন। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ২৭টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত। সবচেয়ে কম সুনামগঞ্জে। ১টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যান সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ৫ বছরে প্রায় ২৭০০০ দুর্ঘটনায় প্রায় ৩৭০০০ মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৮৩০০০ মানুষ আহত হয়েছে। এই আহত ও নিহতের তালিকায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চালক, হেলপারের পাশাপাশি পরিবহণ শ্রমিকেরাও আছে। এতে প্রায় ১ লক্ষ পরিবার পথে বসেছে। দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের পাশাপাশি গাড়ির মালকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন।
প্রতিটি সড়ক কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায় যে, প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিং দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এছাড়া ক্রটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে, মহাসড়কে উল্টোপথ গাড়ি চালানো যা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। তাহলো চালকদের অসাবধানতা, অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক; যানবাহনে ব্যবহৃত তেলে ভেজাল; রাস্তার স্বল্পতা ও অপ্রশস্ততা এবং রাস্তার অবৈধ অংশ দখল হয়ে যাওয়া; রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা; বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না করে যখন-তখন যেখানে সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি; এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ছোটখাট কারণ রয়েছে। রিক্সা ও ভ্যানের সংখ্যাধিক্য যা মহানগরের ভয়াবহ যানজটের মূল কারণ; প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশের অভাব ও ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করা এবং অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞ ও ক্ষেত্রবিশেষে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অদক্ষ রিক্সাচালকদের রিক্সা ও ভ্যান চালনা; সড়কের উপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা; অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, ওভারব্রিজের স্বল্পতা, অসাবধানে রাস্তা পারাপার বা রাস্তা পারাপারের নিয়ম মেনে না চলা প্রভৃতি কারণে যানজট সৃষ্টির ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার যে চিত্র তা সত্যি ভয়াবহ এবং দুঃখজনক।
পরিবহণ সেক্টরে কিছু মাফিয়া চক্র কাজ করে। তারা চালকদের একটি দৈনিক ভিত্তিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে দেয় ফলে চালকেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। চক্রটি চালকদের অভয় দেয় যে, কোনো দুর্ঘটনা হলে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সমাধানের চেস্টা করবে ফলে চালকদের কোনো অসুবিধা হবে না। আবার কিছু শ্রমিক নেতা কোন চালক গ্রেফতার হলে পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দেন ফলে জন দুর্ভোগ বেড়ে যায় চালকেরা আরো সাহস পেয়ে যায়।
দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ছিনিয়ে নিচ্ছে মানুষের অমূল্য জীবন। ভেঙে দিচ্ছে অসংখ্য সাজানো সংসার। স্বজন হারা মানুষের আহাজারি, পিতৃহারা সন্তানের আকুতি সত্যি হৃদয় বিদারক। সরকারের হিসেবে এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বছরে চারশো এর অধিক। কোথাও বাসের সাথে বাস, কোথাও বাসে-ট্রাকে, কোথাও টেম্পু-বাস, আবার কোথাও কার্ভাডভ্যানের সাথে মাইক্রোবাস। আবার কোথাও রিক্সা বা নিরীহ পথচারীকে চাপা দেয় দ্রুতগামী বাস বা ট্রাক। কেড়ে নেয় অমূল্য মানব জীবন। সুতরাং সড়কের ভয়াবহ এ নৈরাজ্যজনক অবস্থা হতে প্রতিকারের জন্য কতিপয় সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। সেগুলো হলো: অনির্ধারিত স্থানে গাড়ি পার্কিং বন্ধকরণ; প্রয়োজনে উচ্চহারে জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা; সাবধানে গাড়ি চালনার জন্য চালকগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি মহাসড়কে অবৈধ রিক্সার অনুপ্রেবেশ রোধ; মহানগর সমূহে রিক্সা চলাচল সীমিত করতে হবে, প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে; অন্যথা ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিকরণ মোটেই সম্ভব নয়; লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন কেউ যেন গাড়ি চালাতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখাও আবশ্যক; মোটর যান অধ্যাদেশের ১৪৩, ১৪৬ ও ১৪৯ ধারায় যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে তা বাড়ানো দরকার; সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তি অর্থাৎ সিআরপিসির ৩০৪ বি ধারা পরিবর্তন করে সাজার পরিমাণ ০৭ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা হয়েছে। এ শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়িয়ে ১০ বছর করা প্রয়োজন; গাড়ি রাস্তায় বের করার পূর্বে এর যান্ত্রিক কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে; মহানগরকে রিক্সামুক্ত এবং হাইওয়েতে রিক্সা চলাচল বন্ধ করা খুবই জরুরি। হাইওয়েতে মানুষ বা মানুষ চালিত বাহন চলাচল বন্ধ করে তাদের জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরি করা প্রয়োজন। বীমা আইনের আওতায় বীমার টাকা তোলার বিষয়টি আরও সহজ করা দরকার।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ফিটনেসবিহীন গাড়ি, দ্রুতগতি, অদক্ষ চালক, চালকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ ১০টি কারণ তুলে ধরে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনতে দক্ষ চালক বাড়ানো, সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার, চালকদের কাজের সময় নির্ধারণ, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রধানমন্ত্রী চালকদের ডোপ টেস্টের মাধ্যমে চালকদের ফিটনেস পরীক্ষার কথা বলেছেন। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। চালকদের পাশাপাশি তিনি সাধারণ মানুষদের সচেতনভাবে চলাচল করার পরামর্শ দিয়েছেন। যত্রতত্রভাবে রাস্তা পার না হওয়া, বাস স্টপেজ ছাড়া যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে ওঠা নামা না করা। মহাসড়কে অতিরিক্ত সার্ভিস লেন চালু করা যাতে ধীরগতির গাড়িগুলো চলতে পারে।
স্কুলছাত্র ও শিশুকিশোরদের বাংলাদেশ বিনির্মানের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিরাপদ সড়ক সুস্থ জীবন। এই আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞগণ আশা প্রকাশ করেন।
(ঊষার আলো-এমএনএস)