সেলিনা আক্তার : আন্তর্জাতিকভাবে মাদকের ভয়াবহতা রোধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবছর ২৬ জুনকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় দিনটিকে মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৬ জুন জাতিসংঘ ঘোষিত ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ প্রথম বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। এর লক্ষ্য হলো মাদকরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মাদকাসক্তির চিকিৎসার বিষয়ে সর্বসাধারণকে অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Share facts on drugs, save lives’। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ চেতনানাশক দ্রব্য কনভেনশন ১৯৭১ এর ১৯৮৮ সালের মাদকদ্রব্য ও চেতনানাশক দ্রব্যেও অবৈধ পাচাররোধে জাতিসংঘ কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। সরকার জাতিসংঘ কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ সংশোধন করেছে। ১৯৯৩ সালে মাদকদ্রব্য অপব্যবহার রোধ ও নিয়ন্ত্রণের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ কারিগরি বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে উপনীত হয়।
বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা সবকিছুতেই বাংলাদেশের উন্নয়ন উল্লেখ করার মতো। কর্মক্ষম মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আহরণে বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মাদকাসক্তি একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে, মাদকাসক্তের হার দিন দিন বাড়ছে। যুবসমাজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। মাদকাসক্তি এমন দুর্বার নেশা যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। মাদকাসক্তি জাতীয় জীবনকে এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা-মানসের জরিপ বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি মাদকাসক্ত রয়েছে। যার মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ২০ লাখ। তাদের হিসেবে, ১০ বছর আগেও নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের মাদক গ্রহণের
হার বৃদ্ধি সমাজের জন্য মহাবিপদ সংকেত। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাদক গ্রহণের ফলে নারীরা পুরুষের তুলনায় মানসিকভাবে বেশি বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। নারীদের শারীরিক ঝুঁকিও বেশি।
মাদকদ্রব্যের নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নাম বলা কঠিন। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যে কোনো মাধ্যম। বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রচলিত নেশাদ্রব্য হলো গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ, তাড়ি, মারিজুয়ানা, এলএসডি, অ্যালকোহল, প্যাথেড্রিন, কোকেন, মরফিন, চরস, পপি, হাশিশ, ক্যানাবিস, স্মাক, বোড়েন, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘুমের ঔষধ, জুতায় লাগানো আঠা ইত্যাদি। অনেকে বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংকসের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়েও নেশা করে থাকে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেট। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে শতকরা ছয়গুণ।
ল্যাটিন আমেরিকার পর ভয়াবহ মাদক উৎপাদনকারী দুটি জনপদের একটি আফগানিস্তান, অন্যটি মিয়ানমার। মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী, আফগানিস্তানও দূরে নয়। এর বাইরে সীমান্ত এলাকাগুলোর কাছাকাছি ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক উৎপাদনকারী কারখানা থাকায় মাদকের বড়ো ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। মাদক উৎপাদনকারী দু’টি অঞ্চল হলো গোল্ডেন ট্রায়াংগল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট। গোল্ডেন ট্রায়াংগলের মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী
তিনটি দেশ হলো মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং লাওস। গোল্ডেন ক্রিসেন্টের দেশগুলো হচ্ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান। সুতরাং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে বহুদিন ধরেই ব্যবহার হয়ে আসছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লক্ষাধিক। বাংলাদেশে যারা মাদকে আসক্ত তাদের অধিকাংশের গড় বয়স ১৮ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে। আসক্তদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ। অধিদপ্তরের জরিপে পাওয়া যায়, আসক্তদের শতকরা ৯০ ভাগ কিশোর ও তরুণ। তাদের শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার ও ৬৫ ভাগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট।
বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- দেশে মাদকাসক্তের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর মাদক সেবনের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ। প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনা-বেচা হয়। ধারণা করা হয় মাদকাসক্তের মধ্যে ৫০ শতাংশই বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। আমাদের দেশে নারী মাদকাসক্তদের সংখ্যাও বাড়ছে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, নারী আসক্তদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩৫, বাকিদের বয়স ৪৫ এর মধ্যে। মাদক গ্রহণের অন্যতম কারণ বেকারত্ব বা কর্মহীনতা। কথায় আছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। মাদকের নেশা এখন নগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের দেশে কিশোর সন্ত্রাসীদের ক্রমবর্ধমান দাপটের যে তথ্য সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার অন্যতম কারণ মাদক। দেশের সর্বত্র স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম। তাই বেকার সমস্যার আশু সমাধান করে তরুণ ও বেকারদের মধ্য থেকে মাদকাসক্তি দূর করতে হবে; মাদকের বিক্রয় ও বিপণন নিষিদ্ধ করতে হবে।
মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ও প্রকাশ্যে বেচাকেনা রোধে সমাজের সকলকে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মাদকাসক্তি দূর করতে কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে মাদকদ্রব্যের কুফলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও মিডিয়ার মাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। ছেলেমেয়েদের প্রতি পরিবারের যত্ন ও দায়িত্ব বাড়াতে হবে। তারা কী করছে, কতক্ষণ বাইরে থাকে, কাদের সঙ্গে মেশে এসব খবর রাখতে হবে অভিভাবকদের। মাদকদ্রব্যের চোরাচালান ও এর প্রসাররোধে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাদকাসক্তের চিকিৎসাগ্রহণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। সেই সাথে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং সুস্থ ও নির্মল চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অধীন সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে ১৫৫টি অফিস রয়েছে। যে কোনো ধরনের মাদকের অপব্যবহার, পাচার এবং মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের বিষয়ে তারা কাজ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত বিষয়ে লিয়াজোঁ রক্ষা করে। মাদকাসক্তদের চিকিৎসার্থে সরকারিভাবে ঢাকায় রয়েছে ২৫০ শয্যার চিকিৎসাকেন্দ্র।
এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় রয়েছে ৫০০ শয্যার চিকিৎসাকেন্দ্র। সরকার মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। তার নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং সমাজকে মাদকমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতার কারণে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে এ সংস্থা।
মাদকের বিস্তাররোধে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধরা পড়ছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে মাদকবিরোধী অভিযান। নানা রকমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে একযোগে মাদকের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভিশন হচ্ছে মাদকাসক্তি মুক্ত বাংলাদেশ গড়া। আর মিশন হচ্ছে দেশে অবৈধ মাদকের প্রবাহ রোধ, ঔষধ ও অন্যান্য শিল্পে ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মাদকদ্রব্যের সঠিক পরীক্ষণ, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিতকরণ, মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরোধ শিক্ষা কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে নিবিড় কর্মসম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ-সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মাদকদ্রব্যের প্রচার ও প্রসার বন্ধ করা, নজরদারি বৃদ্ধি এবং মাদকদ্রব্য ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে দেশ ভবিষ্যতে একটি মাদকমুক্ত জাতি পেতে পারে। আসুন, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সবাই সচেতন হই, দলমত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে কাজ করি। জীবনকে ভালোবেসে সবাই মাদকমুক্ত থাকি।
(ঊষার আলো-আরএম)