UsharAlo logo
বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শত প্রতিকূলতায়ও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা কয়রায় আদিবাসীদের

koushikkln
নভেম্বর ১৯, ২০২১ ১০:২৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো প্রতিবেদক : কয়রা উপজেলা উত্তরবেদকাশি হরিহরপুর গ্রামে সুন্দরবনের কোলঘেষে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ এলাকায় বসবাস করেন আদিবাসী উত্তম মাহাতো। বয়স তার ৫২-এর কোটায়। স্ত্রীসহ পাঁচজনের সংসার তার। কাঁকড়া ও মাছ শিকার এবং কৃষি কাজ তার পেশা। তবে এখন কৃষি কাজ পুরোটাই বন্ধ। কাকড়া ধরে কোনভাবে তাদের সংসার চলছে। শুধু তার একার নয়, ওই এলাকায় একসাথে বসবাস করে ৫৬ আদিবাসী পরিবার। প্রায় সবারই নুন আনতে পানতা ফুরোয়। আর্থিক অনাটন তাদেও পিছু ছাড়ে না। তাদের দেখা আর শোনার কেউ নেই। বলার মতো কেউ আছে বলে মনে হয় না। এমনই ভাবে কষ্টের কথাগুলো বলেন আদিবাসী উত্তম মাহাতো।

তিনি বলেন, সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পুরো এলাকা পানিতে ডুবে যায়। এখনও কৃষি জমি পানির নীচে তলিয়ে আছে। কবে নাগাদ এ কৃষি জমিতে আবার তারা ফসল ফলাবেন তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। এ জন্য আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা অধিকাংশই বেকার জীবন যাপন করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্পান, করোনা মহামারির পর ইয়াস। পর পর তিনটি দুর্যোগ আদিবাসীদের সকল স্বপ্ন লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ইয়াসের প্রভাবে অনেকের ঘর বাড়ি ভেসে যায়। তিনি বলেন, তাদের কারো কারো ঘরে জোয়ারের পানি ওঠে। এসব দুর্যোগের পর সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ আসলেও তাদের পর্যন্ত আসে খুবই সামান্য। যা তাদের চাহিদার তুলনায় কম। এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বর ও তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা ত্রাণ ভাগভাটোয়ারা করে নেয়। সরকার তাদের ব্যাপারে আন্তরিক থাকলেও মধ্যসত্বভোগীদের কারণে তারা নানা অধিকার থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। তারপর যৎ সামান্য থাকে যা তাদের মাঝে বন্টন করা হয়। তবে উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে তার ভাল সম্পর্ক থাকায় তাকে একটি টিনের ঘর করে দেয়া হয়। অন্যরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সুখের সংসার। সন্তানরা লেখা পড়া করে। তার দু’সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে। সে স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ছেলে একই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তারা স্থানীয় কপোতাক্ষ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। পায়ে হেটে বাড়ি থেকে আনুমানিক ১৫ মিনিট সময় লাগে স্কুলে পৌছাতে। ওই এলাকার অধিকাংশ আদিবাসী পরিবারের সন্তানরা স্কুলগামী। যেটা আগে ছিল না। তবে আগে তারা দিন মজুর করে সংসার পরিচালনা করলেও বর্তমানে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। অনেকের সন্তান লেখা পড়া করে সরকারি-বেসরকারি চাকুরি করছে। এতে করে এলাকার পরিবেশ ও তাদের পর নির্ভরতা কিছুটা কমছে। তবে তাদের সন্তানদের স্কুলগামী করতে বিভিন্ন এনজিও’র পরামর্শ ও উৎসাহ এখন কাজে লাগছে বলে তিনি জানান।

জলাবায়ু পরিবর্তনের শিকার আরেক আদিবাসী নেতা ধীরেশ প্রসাদ মাহাতো (৪৫)। তিনি জনসেবা আর ঘের ভেড়ী করে জীবন যাপন করেন। ১৮ জনের সমন্বয়ে বড় সংসার তার। মা-বাবা,ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে সবাই এক সাথে থাকেন। এত বড় পরিবার এখনও দেখা মেলাই যেন কস্টকর। গত ২১ মেইয়াস নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আম্পানের ক্ষত না শুকাতেই আছড়ে পড়ে ইয়াস। ইয়াসে এলাকার বেড়িবাধ ভেঙ্গে যাওয়ায় বেশীরভাগ ঘের পানিতে ভেসে যায়। এলাকার ৫৪টি আদিবাসী পরিবারের মধ্যে ৭৫ ভাগ ঘের করে সংসার পরিচালনা করে। ঘের ভেসে যাওয়ায় তারা অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এখন তারা কাকড়া ধরে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। সমিতির ঋণ দিয়ে চলছে তাদের বাজার ঘাট। এতে করে সবজি ভাত জোটানো কস্টকর হয়ে পড়েছে। মাছ-ভাত দুরের কথা। চাপা কস্ট নিয়ে দিন কাটছে এসব আদিবাসি জনগোষ্ঠীর। তিনি বলেন, কয়রার আদিবাসীরা দু’টি গোত্রে বিভক্ত। একটি মাহাতো আর অপরটি মুন্ডা। এখানকার ৫৪টি পরিবারের মধ্যে ৭টি পরিবার মুন্ডা পরিবার।

স্থানীয় হরিহরপুর গ্রাম আদিবাসী মাহাতোপাড়া হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগিতা এসেছে। তবে তা আদিবাসীদের কাছে আসতে আসতে অনেক শেষ হয়ে যায়। স্বজন আর দলীয় প্রীতির কারণে চাহিদার তুলনায় তারা ত্রাণ কম পান। তিনি বলেন, কয়রা উপজেলায় ৩৩২টি আদিবাসী পরিবার বসবাস করে। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৬শত। এ জনগোষ্ঠী বৈষম্যে শিকার। বৈষম্যের কারণে তারা সমাজে সুযোগ-সুবিধা সঠিকভাবে পাচ্ছেন না। বৈষম্য এতই প্রকট যে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যা লঘু হলেও তারা অতি সংখ্যালঘু। তাদের মতামত ও প্রস্তাবে কেউ মূল্যায়ন করেন না। এছাড়া মধ্যসত্তভোগীরা তো আছেই। এসব কারণে তারা ত্রাণসহ নানা অধিকার থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। তিনি আরও বলেন, অস্থায়ীভাবে তারা যা পাচ্ছেন তা পর্যাপ্ত নয়। তবে তারা স্থায়ীভাবে কিছু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এত কিছুর পরও তিনি তার পরিবার নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় তার পরিবারের সদস্য মুকুন্দ প্রসাদ মাহাতো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে চাকরি খুঁজছেন।

আরেক সদস্য হর প্রসাদ খুলনা সরকারি সুন্দরবন কলেজে অনার্স পড়ছে। অন্য সদস্য ববিতা মাহাতো খুলনা পাইওনিয়ার কলেজে অধ্যায়নরত। তিনি বলেন, এরা লেখাপড়া শেষ করে নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি এ জনগোষ্ঠিকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। এদের মত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সন্তানরা এখন অনেকেই লেখাপড়া করছে। আবার কেই চাকরি করে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করছে। যা গত ১০/১২ বছর আগে ছিল না।
কয়রা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সুমিলা মুন্ডা বলেন, প্রথমত সচেতনতার অভাবে শিক্ষার প্রসার কম। মনে করা হয়, পড়ার চেয়ে মাঠে কাজ করলে রোজগার বেশি হবে। এ ছাড়া পরিবারের বড় সদস্যরা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকায় সন্তানদের পড়াশোনার খোঁজ নেওয়ার কেউ থাকে না। তারা ঠিকমতো বিদ্যালয়েও যান না।

কয়রা উপজেলার ৬নং কয়রার টেপাখালী গ্রামের এই এলাকায় আদিবাসী মুন্ডাদের বাস। এখানে বাস করে ৪২ ঘর মুন্ডা, যারা মূলত কৃষিজীবী। মাছ ধরতে ও বনে গিয়ে মধু সংগ্রহে খুব কমই যায় তারা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি জমি কমে যাওয়ায় বর্তমানে টেপাখালীর মুন্ডাদের পেশা বদল করেছে। তবে পরিবারের কেউ কেউ লেখা পড়া শিখে শহরে উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্ন আঁকছে এমনই আশারবাণী শোনালেন বলয় মুন্ডা। কয়রা সদরের মাঝিরহাট গ্রামের আদিবাসী সুব্রত মুন্ডা জানান, আম্পানে তার ঘরবাড়ি ভেসে যায়। পরে মুজিব বর্ষে সরকার তার ছোটভাই গণেশকে একটি ঘর দিয়েছে। তার দু’ ছেলে মেয়ে। ছেলে সুন্দরবন হাইস্কুলে আর মেয়ে প্রাইমারীতে পড়ে। তিনি কোন রকম লেখাপড়া জানলেও সন্তানদের শিক্ষিত করতে চান।

আদিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইনেশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ (আইআরভি)-এর সমন্বয়কারী কাজী জাবেদ খালিদ পাশা জয় বলেন, সরকার আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়। কিনউত তা পুরোপুরি বাস্তবায়নে নানা সংকট দেখা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ জনগোষ্ঠী সর্বদা উৎকন্ঠার মধ্যে জীবন যাপন করে। জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘের সাথে লড়াই করেই তাদের জীবন পরিচালিত হয়। এসব সংকট মোকাবেলা করে এখন আদিবাসী পরিবারের সদস্যরা লেখাপড়া শিখে স্বনির্ভর হচ্ছে। যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে আরো আন্তরিক হলে আদিবাসীরা সমাজে বোঝা না হয়ে সম্পদে রূপান্তির হবে বলে তিনি আশাবাদী।

কয়রার উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, কয়রার আদিবাসী মুন্ডা ও মাহাতো পরিবারের সংখ্যা ২৯৬টি। তাদের সদস্যদেরকে স্বাবলম্বী করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বে-সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাদেরকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান। এছাড়া মুজিববর্ষে তাদের ৩০টি ঘর দেয়া হয়েছে। দুর্যোগকালিন ১০টন চাউল দেয়া হয়েছে। ২০টি গাভী দেয়া হয়েছে। স্কুলগামী মেয়েদের ২০টি বাই সাইকেল দেয়া হয়েছে। ৫০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আদিবাসীদের লেখাপড়ার হার বাড়াতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারই অংশ হিসেবে কয়রা সদরে করা হচ্ছে বিলসা মুন্ডা নামের একটি প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়।