UsharAlo logo
বৃহস্পতিবার, ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বাংলা সনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির ঐতিহ্যগত অনুভব

pial
এপ্রিল ১১, ২০২২ ৫:০১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সোহেল সানি : বাংলা সনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির ঐতিহ্যগত অনুভব। বাংলা সন বাংলাদেশের নিজস্ব সন। এর উৎপত্তি ও বিকাশের ইসলামী উত্তরাধিকার সঞ্চাত। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় এই বর্ষপঞ্জী ব্যবহৃত হয়।

ভারত সাম্রাজ্যের সম্রাট আকবরের আদেশে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তারই বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী আমির ফতেহ উল্লাহ শিরাজীর গবেষণার ঐতিহাসিক ফসল বাংলা সনের উৎপত্তি ঘটে। ব্রিটিশ রাজত্বের আগে এ দেশে মানে সমগ্র ভারতে হিজরী সনই প্রচলিত ছিল। সামাজিক ক্ষেত্র বিশেষ করে মৌসুমের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরী সনের পরিবর্তে ঋতুভিত্তিক সৌরসনের প্রয়োজনবোধ করে বাংলা সন বঙ্গাব্দের উদ্ভব ঘটানো হয়।

মানুষ কাল বা সময় বিভাজনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আসছিল, সভ্যতার বিকাশের আদি যুগ থেকেই। প্রয়োজনের তাগিদে বছর, মাস, সপ্তাহ দিন ইত্যাদি গণনার প্রচলন করে। বাংলায় শকাব্দ, লক্ষনাব্দ,পালাব্দ, চৈতন্যাব্দ ইত্যাদি সনের প্রচলন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুরু হয় বাংলা বা বঙ্গাব্দের প্রচলন । এই সন প্রচলনের ইতিহাসে সংযোগ ঘটেছে বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ। বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের জনক নিয়েও রয়েছে মতভেদ। তবে এ মতভেদ দূর করার চেষ্টা করেছেন নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ও বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। এ দুই ব্যক্তিত্বের দৃষ্টিপটে ভারত সম্রাট মহামতি আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক।

বাংলা সন বাংলার ঐতিহ্য পরস্পরায় এক অনন্য সাংস্কৃতিক উপাদানে পরিণত হয়েছে। বাংলা নববর্ষ এলে পহেলা বৈশাখে বাঙালিরা আনন্দঘন উল্লাসে বিমোহিত হয়ে পড়ে। সারা বছরই যেন ধরে রাখার মধ্যে আমাদের বাঙালির স্বকীয়তার তাৎপর্য নিহীত রয়ে যায়।

বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বাংলা বর্ষপঞ্জী হলো বঙ্গদেশের একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত সৌর পঞ্জিকাভিত্তিক বর্ষপঞ্জী। ঋতু বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলা পঞ্জিকা বাঙালির জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ও বটে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌদদিনের গণনা শুরু। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা লাগে। এই সময়টাই সৌর বছর। গ্রেগরীয় সনের মতো বঙ্গাব্দেও মোট ১২ মাস। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। আকাশের রাশিমন্ডলীতে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব হয়। যেমন যে সময় সূর্য মেষ রাশিতে থাকে সে মাসের নাম বৈশাখ।

বঙ্গাব্দ শুরু হয় পহেলা বৈশাখ দিয়ে। বঙ্গাব্দ সব সময়েই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর অপেক্ষা ৫৯৩ বছর কম। সংশোধিত বাংলা পঞ্জিকা বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় ১৯৮৭ সালে। সেই অনুযায়ী আজকের তারিখ ৩০ চৈত্র ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সনে বাংলা পঞ্জিকার প্রশ্নে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নেতৃত্বাধীন কমিটির রেখে যাওয়া সুপারিশ গ্রহণ করেছে। যদিও ১৪ এপ্রিল বছর শুরুর দিন হিসেবে ধার্য করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকার অধিবর্ষের বছরে চৈত্র মাসে একদিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনভুক্ত হয়। ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ জয়ের পর মুসলমান শাসনামলে তৎকালীন প্রচলিত শকাব্দ ও লক্ষনাব্দ সনের পাশাপাশি শাসনতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয়। সন শব্দটি আরবী শব্দ হতে উদ্ভূত, অর্থ বর্ষ। আর সাল কথাটা ফার্সি শব্দ হতে। বাংলা সনের জনক নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ভারত সম্রাট আকবরের পাশাপাশি রাজা শশাঙ্ক, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর নামও কোন কোন লেখক উল্লেখ করেছেন তাদের মনগড়া যু্ক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। যদিও ঐতিহাসিকদের যুক্তিবলে প্রমাণিত যে, মহামতি আকবরই বাংলা সন প্রবর্তনকারী।

এদেশে সবাই হিজরী সনই ব্যবহার করতো। ফলে ফসল কাটার খুব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো, কারণ আগের বছর যে তারিখে ফসল কাটতো, পরের বছর সে তারিখ ১১ দিন এগিয়ে যেতো। আকবর যে হিজরী সন ছিল তখন থেকেই এক সৌরসংবত প্রবর্তন করেন। এটিই হচ্ছে বঙ্গাব্দ। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ (হিজরী ৯৬৩) এবং ৯৬৩ বঙ্গাব্দ। এই থেকে ঐতিহাসিকরা একমত হন যে, হিজরী থেকেই বঙ্গাব্দ চালু করা হয়। ৫২২ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ হিজরী সনের শুরু হযরত মোহাম্মদ নবী করিম (সঃ) এর সময় হতে হিজরতের স্মৃতি রক্ষার্থে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রাঃ) খিলাফতকালে হিজরী সনের সৃষ্টি। এই সনের শুরু ১৬ জুলাই ৬২২অব্দ ধরা হলেও আসলে হিজরতের তারিখ রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার। ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ অব্দ ধরা হলে আরব দেশের নিয়মানুযায়ী বছরের প্রথম মাস পহেলা মহরমের তারিখ হতে বছর ধরা হয়েছে।

হিজরী সন ছিল চন্দ্রমাস। ওই মাসই হিজরী সন ও তারিখের হেরফের হতো, অর্থাৎ সৌর বছরের হিসাবের দিন তারিখ মাসের গরমিল হতো প্রচুর। সে কারণেই ৯৬৩ হিজরী = ৯৬৩ বাংলা সন সমন্বয় করে গণনা শুরু করা হয়। এভাবে ৯৬০= হিজরী = ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ এর ১১ এপ্রিল, সম্রাট মহামতি আকবরের সিংহাসন আরোহণের ও পহেলা বৈশাখ, ৯৬০ বাংলা সন। এসব একদিকে নবী করিম (সঃ) এর হিজরতের (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ), বাংলা সনের শুরু ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এবং আকবর সিংহাসন বসার (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) স্মৃতিবহ এবং ইংরেজী সন থেকে ৫৯৩ বছর ৩ মাস ১১ দিন কম। বাংলা সনের সঙ্গে ৫৯৩ যোগ দিলেই ইংরেজি সন মিলতে পারে। আকবর অবশ্য তার রাজত্বের ২৯তম বর্ষে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে এই বাংলা সন চালু করেন। আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল। যদিও তার সিংহাসনে বসার প্রকৃত দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি। বাংলায় আদি হতে ঋতু বৈচিত্র্য অনুসারে বাংলা সন চালু করা হয়। রাজার অভিষেক শুরু রাজ্যাভিষেকের বছর ধরে যে সব পঞ্জিকার বছর গণনা শুরু করা হয়, সে সকল বছরের যে দিনেই রাজার অভিষেক হোক না কেন, ঐতিহ্যের খাতিরে বছর শুরুর দিন অপরিবর্তিত রাখা হয়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।

(ঊষার আলো-এফএসপি)