ঊষার আলো রিপোর্ট : পুঁজির বড় ধরনের সংকটে ভুগছে দেশে ক্ষুদ্র পোলট্রি খামারিরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এ খাতে ঋণ দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এই সুযোগ নিয়ে করপোরেট ডিলাররা খামারিদের হাতে বেশি মূল্যে বাকিতে তুলে দিচ্ছে একদিনের মুরগির বাচ্চা, পোলট্রি খাদ্য ও খামারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। আর বাজার মূল্য থেকে অধিক দিয়ে উপকরণ কিনতে গিয়ে খামারিদের বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়। অপরদিকে উৎপাদন শেষে ডিলারদের বকেয়া পাওনা শোধ করতে গিয়ে অনেকে লোকসানের মুখে পড়ছেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম বলেছেন, পোলট্রি ও ডিম উৎপাদনের প্রান্তিক খামারিদের করোনাসহ অন্যান্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে মন্ত্রণালয় নগদ প্রণোদনা দিয়েছে। রাষ্ট্র পোলট্রি খাতে সম্পৃক্তদের সহায়তার চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, পোলট্রি খাত সম্প্রসারণের পাশাপাশি এখন গবেষণায় বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান ক্ষুদ্র খামারিদের ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনেক ব্যাংকই ঋণ দিচ্ছে না। কারণ এ খাতে ঝুঁকি অনেক বেশি। সরকার বিমা চালু করেছেন কিন্তু অনেকেই জানেন না। তা ছাড়া খামারের বিমার চেয়ে জরুরি মুরগির বিমা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ক্ষুদ্র খামারিদের স্বার্থে রাজ্য সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে থাকেন। এ ধরনের সহায়তার ফলে তাদের উৎপাদন খরচ কমে আসে এতে ভোক্তারাও লাভবান হয়। তিনি আরও বলেন, পোলট্রি শিল্প রক্ষায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পলিসির আওতায় যদি কাজগুলো করা হয়, তবে শুধু পোলট্রি খাত নয় বরং সমগ্র জাতি উপকৃত হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত গত ২৪ বছরে ৮৬ কোটি ২১ লাখ টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয় খামারিদের মধ্যে। এর সুফল পেয়েছেন ১ লাখ ২৯ হাজার ১০৮ জন। ওই হিসাবে প্রতি খামারি দুই যুগের বেশি সময়ের ব্যবধানে গড়ে ঋণ পেয়েছেন মাত্র ৬৬৬১ কোটি টাকা। অবশ্য একই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু খামারিদের এই অর্থ খুবই সামান্য। বলতে গেলে ক্ষুদ্র ঋণ এ খাতে আসছে না।
জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী এক হাজার বয়লার মুরগির খামারি ৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ঋণ পাওয়া কথা। কিন্তু সেখানে ব্যাংকগুলো একদম ঋণ দিতে উৎসাহবোধ করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কৃষি খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করছে। কিন্তু এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ ও পোলট্রি খাতে বিতরণের হার খুবই কম। কোনো বছরই এক হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণ বিতরণ করতে পারেনি।
ঋণ না পেয়ে অনেক খামারি নানাভাবে ডিলারনির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। জানতে চাইলে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় অদল গ্রামের পোলট্রি খামারি রকিবুল বলেন, পুঁজির সংকটই তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। স্পর্শকাতর হওয়ায় ক্ষুদ্র খামারিদের ঋণ দিতে চায় না ব্যাংকগুলো। নিরুপায় হয়েই ডিলারদের কাছ থেকে বাকিতে ফিড, বাচ্চা এমনকি ওষুধ নিতে হয়। বিপরীতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত দাম পরিশোধ করতে হয়। ডিম ও মুরগি উৎপাদনের পর পরিশ্রমের ফসল প্রায় পুরোটাই যায় ডিলারদের পকেটে।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় অদল গ্রামের পোলট্রি খামারি রকিবুলের মতো অনেকের পুঁজির সংকট কাজে লাগিয়ে ডিলাররা মহাজনি ব্যবসা শুরু করেছে। প্রত্যক্ষ ও প্ররোক্ষভাবে জিম্মি হচ্ছে খামারিরা। এতে অনেকে লোকসানও গুনছেন। অন্যদিকে এসবের প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে ডিম ও মুরগির মাংসের দাম।
মদিনা পোলট্রি ফার্মের মালিক মাসুদ মিয়া বলেন, খামার করে কোনো ব্যাংক ঋণ পাইনি। যদিও আমার ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। বর্তমানে ৪০ হাজার লেয়ার মুরগি আছে। এ রকম ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থা। তিনি আরও বলেন, আগে ৫০ কেজির পোলট্রি খাদ্য দাম ছিল ১৭শ টাকা। বর্তমানে বেড়ে ৩ হাজার টাকা হয়েছে। কিন্তু ডিলাররা ওই খাবারের বস্তা বাকিতে দিচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩২শ টাকায়।
কুমিল্লার নিমসার বাজারের পোলট্রি খাদ্যের ডিলার দেশ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জামাল হোসেন বলেন, গত এক বছরের ব্যবধানে পোলট্রি খাদ্যের বস্তা প্রতি ১৮শ টাকা বেড়েছে। তবে খামারিদের বাকি দেওয়ার কারণে খাদ্যের দাম বেশি রাখা হয়। উৎপাদন শেষে বকেয়া টাকা শোধ করে উদ্যোক্তারা।
পোলট্রি দেশের সম্ভাবনাময় খাতের মধ্যে অন্যতম। প্রতিবছর এ খাতে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। কমপক্ষে ৬০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে এ খাতে। কিন্তু সেভাবে পুঁজির সংকট কাটছে না।
ঊষার আলো-এসএ