ঊষার আলো রিপোর্ট : ডলার সংকট মোকাবিলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় করতে দেড় বছর ধরে দেশে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে আমদানি কমেছে। এতে আমদানিনির্ভর ঋণ বায়ার্স ক্রেডিট বা ক্রেতার ঋণ কমছে।নয় মাসের ব্যবধানে দেশে বায়ার্স ক্রেডিট (আমদানির বিপরীতে আমদানিকারককে বিদেশি ব্যাংক বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যে ঋণ দিচ্ছে) কমেছে ২৯২ কোটি ডলার। আমদানি কমায় আমদানিনির্ভর শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে এ ঋণ কমায় বৈদেশিক ঋণে সুদের বোঝা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে বায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি ছিল ৯৫৭ কোটি ডলার। গত অক্টোবর পর্যন্ত তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৬৫ কোটি ডলার। আলোচ্য নয় মাসে বায়ার্স ক্রেডিট কমেছে ২৯২ কোটি ডলার।
উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির বিপরীতে এই ঋণ নিয়ে থাকেন। কোনো ব্যাংক বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে এই ঋণ নেওয়া হয়। অনেক সময় বাকিতে পণ্য আমদানি করেও ঋণ নেওয়া হয় সরাসরি রপ্তানিকারকের কাছ থেকে। এই ঋণে দেশে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি হলে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমে। কিন্তু বায়ার্স ক্রেডিটে আমদানি করা বেশির ভাগ পণ্যই বাণিজ্যিক। এসব পণ্য আমদানিতে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কড়াকড়ি আরোপ করেছে। যে কারণে সার্বিকভাবে আমদানি কমেছে। এর প্রভাবে কমেছে বায়ার্স ক্রেডিট।
বায়ার্স ক্রেডিটের শতভাগ ঋণের সুদই বাজারভিত্তিক। যে কারণে এ ঋণের সুদের হার ওঠানামা করে। তবে বর্তমানে সব খাতে সুদহার বাড়ায় এ খাতেও ঋণের সুদহার বেড়েছে। করোনার আগে এসব ঋণের সুদহার ছিল ৪ থেকে ৫ শতাংশ। এখন তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে এখন ঋণ কমায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদের চাপ কিছুটা কমেছে। তবে আমদানি কমায় আমদানিনির্ভর শিল্পগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক আমদানিনির্ভর শিল্প কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। কিছু শিল্প বন্ধের পথে রয়েছে।
পৌনে দুই বছর ধরে ডলার সংকট মোকাবিলা করতে এবং রিজার্ভ সাশ্রয় করতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে গত অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ২০ শতাংশ। এলসি খোলা কমেছিল ৩০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরেও আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৭ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমদানিতে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন। তবে তা দেখেশুনে নিতে হবে। বিলাসী পণ্যে এবং চড়া সুদের ঋণ পরিহার করাটাই ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছরে এসব খাতে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। বৈদেশিক ঋণের বাজারকে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এতে বাছবিচার না করেই যে যেভাবে পারছে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। তখন বলা হচ্ছিল বেসরকারি খাতের ঋণের দায় সরকারকে নিতে হবে না। ওই সময়ে বেপরোয়া গতিতে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ায় এখন ডলার সংকট ও রিজার্ভে চাপ বেড়েছে। একই ঋণের দায় পড়ছে দেশের রিজার্ভের ওপর। যার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে ডলারের প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঊর্ধ্বমুখী ছিল। যে কারণে ওই সময়ে বায়ার্স ক্রেডিট একটি সীমার মধ্যে থেকে স্থিতিশীল হারে ওঠানামা করেছে। করোনার সংক্রমণ কমলে ২০২১ সালে আমদানি বাড়তে থাকে। ফলে ওই বছর থেকে আমদানিও বাড়তে থাকে। ওই বছরে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ২০২০ সালে বায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি ছিল ৪৩৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২১ কোটি ডলারে। ওই সময়ে বেশির ভাগই বিলাসী পণ্য আমদানি হয়েছিল এই ঋণের আওতায়। একই সঙ্গে ওই সময়ে সুদহারও কম ছিল।
কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্র“য়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে ঋণের সুদহারও বাড়তে থাকে। পাশাপাশি ডলার সংকটে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ পিছিয়ে দিয়ে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতে একদিকে ঋণের সুদহার বাড়তে থাকে। অন্যদিকে সময় বাড়ানোর ফলে বাড়তি ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এতে ডলারের ওপর আরও চাপ বাড়ে।
আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে বায়ার্স ক্রেডিটের অঙ্ক কমতে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে পরিশোধ। এ কারণে এ ঋণের স্থিতি কমেছে। ২০২২ সালে জুন পর্যন্ত এ ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছিল ৭৭০ কোটি ডলারে। চলতি বছরের মধ্যে আরও ১৬৫ কোটি ডলার পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ফলে চলতি ডিসেম্বর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৫০০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১৪ সালে বায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি ছিল ১০১ কোটি ডলার। গত ১০ বছরে এ ঋণ বেড়েছে ৫৬৪ কোটি ডলার।
ঊষার আলো-এসএ