ঊষার আলো রিপোর্ট : ঋণখেলাপিদের ধরতে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি বলেছেন, ‘এখন ঋণখেলাপিদের ধরতে হবে, আমি ধরতে চাই।’ তারা অনেক শক্তিশালী, আপনি ধরতে পারবেন কি না জানতে চাইলে তার মন্তব্য-‘দেখা যাক পারি কি না।’ এ সময় মন্ত্রীর পালটা প্রশ্ন-‘সাবেক আইজিপি, আর্মি চিফ কি ধরা পড়েছে। সব সম্পত্তি ক্রোক করেছে।’ এ সময় সাংবাদিকরা অর্থমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেন, আইজিপির সম্পত্তি ক্রোক করেছেন আদালত আর আর্মি চিফকে স্যাংশন দিয়েছে ইউএসএ। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, ইউএসএ দিয়েছে, আর্মি চিফও ধরা পড়েছে। মানে-ইউএসএ দিলেও জিনিসটা তো পাবলিকলি (জনসম্মুখে) চলে এসেছে।’ সাংবাদিকরা বলেন, সেটা সরকার তো কিছু করেনি। জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘গভর্নমেন্ট কিছু করেনি, সেটা আর্মি করবে।’ এ বিষয়ে কি সরকারের সমর্থন আছে-জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন, ‘সমর্থন না থাকলে কি পারবে।’
সেনাবাহিনীতে তিনি (সাবেক সেনাপ্রধান) এখন নেই-এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, বাহিনীতে না থাকলেও সেনাবাহিনী তা করতে পারবে।
এখানে সরকারের সমর্থন আছে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমর্থন ছাড়া কি পারবে। সাংবাদিকরা এ সময় মন্ত্রীকে বলেন, কিন্তু এসব ব্যক্তি তো বড় হয়েছেন সরকারের সমর্থন নিয়ে। এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি অর্থমন্ত্রী।
রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে বসে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে উল্লিখিত সব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) ভারতীয় অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণমূর্তি ভেনকাটা সাবরামাইন, ঢাকায় আলজেরিয়ার চার্জ অব অ্যাফের্য়াস মিসেস বেনতালিব বসমা এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমবার দীর্ঘ সময় সংবাদিকদের সরাসরি মুখোমুখি হলেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় দেশের অর্থনীতি, রিজার্ভ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা, আগামী বাজেটসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতি আগের জায়গায় নিয়ে আসা হবে। তবে অনেক অসুবিধা ও বাধা আছে, সেটি ওভারকাম করতে হবে। আশা করছি, অসুবিধা থাকবে না। অসুবিধা দূর করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে দাতা সংস্থা আইএমএফও সন্তুষ্ট। এ সময় এক সাংবাদিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে অর্থমন্ত্রীকে বলেন, আপনি সন্তুষ্টির পরও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন…। এ সময় সাংবাদিকের প্রশ্ন থামিয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেবপ্রিয়টা কে? আমি তো চিনি তাকে। তখন সংবাদিক বলেন, অর্থনীতি দুর্যোগে পড়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদও, আপনি অর্থমন্ত্রী হিসাবে স্বীকার করবেন কি না? জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘দুর্যোগটা কী, দুর্যোগ মানে কী, আমি বুঝলাম না। শুনেন, বিরুদ্ধে বললেই কি চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। দেবপ্রিয় তো বলবেই।’ কেন বলবে-সংবাদিক জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘উনি তো (দেবপ্রিয়) ওদের লোক, বিরোধী পক্ষের। কিছুই হয়নি, সব নষ্ট হয়ে গেছে, তাহলে কী?’
বর্তমান বিরোধীপক্ষ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও তিনি (দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য) একই কথা বলতেন-এ প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাংবাদিক বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই কি সব বিরোধী পক্ষের হয়। অর্থমন্ত্রীর জবাব-‘না, কিন্তু তার টোনটা দেখতে হবে। কি বলেন সব নষ্ট হয়ে গেল কিছুই না।’ অর্থনীতির কোন সূচকে বাংলাদেশ ভালো আছে-জানতে চাইলে মন্ত্রী এর কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আপনারাই দেখেন’।
প্রথম বাজেটে (অর্থমন্ত্রী হিসাবে) আপনি জনগণকে কি কোনো স্বস্তি দিবেন-জানতে চাইলে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। তবে এটি বলতে হবে, বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনতে অফসোর ব্যাংকিং করা হয়েছে। ডলার এখন ব্যাংকে রাখলেই ৮ দশমিক ৪ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এটি একটি বড় সুযোগ। এছাড়া কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের মাধ্যমে অর্থ উদ্ধার করা হবে। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে অনেক টাকা আটকে আছে। সেগুলো উদ্ধারে চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব খাতে যে অর্থ পড়ে আছে, উদ্ধার করা গেলে সে টাকা দিয়ে অনেক কিছু করা যাবে। সেখানে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ওপরে আছে।’ রাজস্ব আয় বাড়াতে কালোটাকা সাদার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে-এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, সেটি এখন বলতে পারব না, দেখা যাক।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর। এর পেছনে অনেক কাজ আছে। বিশেষ করে দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিগোসিয়েশনের অনেক কাজ আছে। আশা করছি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সমস্যা ওভারকাম (সমাধান) করব। তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে নেওয়া উদ্যোগগুলো সঠিক আছে, এতে সমর্থন দিয়েছে আইএমএফ। ঋণের তৃতীয় কিস্তির প্রস্তাব শিগ্গিরই আইএমএফ-এর বোর্ডে উঠবে। আশা করছি, জুনেই কিস্তি দেবে। কিস্তি পেতে কোনো বাধা নেই।
আসন্ন বাজেটের চ্যালেঞ্জ আছে কি না-জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ। তবে ডলারের মূল্য এখন আর চ্যালেঞ্জে নেই। ডলারের মূল্যের ক্ষেত্রে ‘ক্রলিং পেগ বিনিময় হার’ পদ্ধতি চালু করেছি। এতে আইএমএফও খুশি। অনেক আগ থেকেই সংস্থাটি এ পদ্ধতি চালুর কথা বলে আসছে।
অর্থমন্ত্রী হিসাবে আপনার প্রথম বাজেট এবং এ বাজেটে মানুষকে কীভাবে স্বস্তি দেবেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটিই চেষ্টা করছি আমরা। কী করব, তা এখন বলা যাবে না।
মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে মানুষকে-সেটি আগামী বাজেটে কীভাবে সমন্বয় করবেন জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, সেটিই চেষ্টা করছি।’ এ সময় সংবাদিক জানতে চান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিশ্চয়ই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে-এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, গভর্নর তো আলাদা কিছু না। গোটা সরকারের একটি অংশ। এরপর গভর্নরের প্রসঙ্গ তুলে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেন, ‘এর আগে তিনি অর্থসচিব ছিলেন। কাজেই কিছু পত্রিকায় বলা হয়, তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীন, ওনার কোনো আইডিয়া নেই। এমনি এমনিতে তিনি অর্থসচিব হয়েছেন-পালটা প্রশ্ন রাখেন অর্থমন্ত্রী। এখন তো তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী বলেন, গভর্নর তো বলেছেন, পৃথিবীর কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
এ সময় অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে সাংবাদিকরা বলেন, বিভিন্ন সভার কার্যবিবরণীসহ প্রতিদিন ওয়েবসাইটে উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তথ্য দিচ্ছে, যা এখানে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা পৃথিবী উন্নত দেশের নাগরিক না, কেন তাহলে সেটার রেফারেন্স দেব। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঋণখেলাপি ও ব্যবসায়ীরা প্রবেশ করছে; কিন্তু সাংবাদিকরা পারছে না-এমন নজিরও নেই। তবে এ বিষয়ে গভর্নরের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী কথা বলবেন বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেন।
বাজেটের আকার না বাড়িয়ে সংকোচনমূলক করতে প্রধানমন্ত্রী এবং আইএমএফসহ অন্যরা পরামর্শ দিচ্ছেন। সে আলোকে সংকোচনমূলক হবে কি না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে সেটি হয়েছে। তবে সামনে সংকোচনমূলক থেকে বেরিয়ে সম্প্রাসরণমূলকের দিকে যাচ্ছি। আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার সাড়ে চার শতাংশ বাড়ছে। এটি সম্প্রসারণমূলক হয় কীভাবে-প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কেন বলছি সেটি দেখবেন।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনাই হবে আগামী বাজেটে অগ্রাধিকারের বিষয়। পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং জীবনযাত্রার মান যাতে সহনীয় সীমার মধ্যে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হবে। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি থাকবে বাজেটে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি ইশতেহারে মানুষকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, বাজেটে এর প্রতিফলন থাকবে।
আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাত প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এটি আরও বাড়বে। সম্প্রতি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ইউএনওদের গাড়ি কেনার প্রস্তাব আপনি অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু বৈঠকে এ প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে যিনি ব্রিফ করেছেন তিনি বলেছেন, এ ধরনের প্রস্তাব উঠেনি। এ গোপনীয়তা করার দরকার ছিল কি না জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এটি জানানো উচিত ছিল। কিন্তু কেন জানানো হয়নি, সেটি আমার জানা নেই।
ঊষার আলো-এসএ