।। অনিন্দ্য হক ।।
মহাকবি জন মিলটন বলেছেন, ‘অসীমের পথ খোলার জন্য স্বর্ণ চাবি হচ্ছে মৃত্যু’। বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতার জীবন, কঠোর নীতিবোধ, সময়োনুবর্তীতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে সেই অসীমের পথে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক সাহাবুদ্দীন আহমেদ। তিনি পেছনে রেখে গেলেন দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর গৌরবোজ্জ্বল সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল কীর্তি।
রাজধানীতে নয়, মফস্বল শহরে থেকেও যে বড়ো ও কীর্তিমান সাংবাদিক হওয়া যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সাংবাদিক সাহাবুদ্দীন আহমেদ। তিনি ছিলেন নির্লোভ ও কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি কারো কাছ থেকে কোনো অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেননি। সরকারি-বেসরকারি অনেক হোমড়াচোমরা তাকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তাঁর পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করলেও তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছেন।
অকৃতদার এই মানুষটির হৃদয়ভরা স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁকে নিয়ে কতযে স্মৃতি আছে আমার, তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে, এই মুহূর্তে দু-একটি কথা না বললেই নয়। সম্ভবত ১৯৯২-৯৩ সাল হবে; একবার এক মাসের জন্য আমার পিতা সাংবাদিক আইয়ুব হোসেন ভারতে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, সাহাবুদ্দীন ভাই, আমি না আসা পর্যন্ত আমার পরিবারের প্রতি আপনি খেয়াল রাখবেন। এরপর রাত নেই, দিন নেই, কাকু, আমাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন দিতেন। জিজ্ঞেস করতেন, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কী না, টাকা-পয়সা আছে কী না, বাজারঘাটের কি অবস্থা ? আমি বলতাম, কাকু কোনো অসুবিধা নেই। তারপরও বলতেন, সকাল ১০টার মধ্যে প্রেসক্লাবে চলে এসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে। আব্বা যতদিন ভারতে ছিলেন ঘুম হারাম হয়ে গেল আমার।
আমার আব্বা, ২০০৬ সালের ১৩ মে মারা গেলে, কাকু আর মাত্র তিন বছর ছিলেন খুলনাতে। প্রতি ঈদে তিনি আমাকে শার্টের কাপড় কিনে দিতেন। তাঁর মুখের ওপর না বলা যেত না। তিনি ফোন দিয়ে বলতেন, এনাম, এখন কয়টা বাজে? আমি বলতাম কাকু, সকাল সাড়ে ৯টা। তিনি বলতেন, সাড়ে ১০টার মধ্যে আক্তার চেম্বারের সামনে চলে এসো। আবার বলতেন, কয়টার মধ্যে আসবা? আমি বলতাম, সাড়ে ১০টা। ঠিক সাড়ে ১০টা, এক মিনিট যেন লেট না হয়। আধা ঘণ্টা আগেই আক্তার চেম্বারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। যারা সাংবাদিক সাহাবুদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে জানেন, তারা জানেন এক মিনিট লেট হলে তার কী অবস্থা হতো।
সাংবাদিক আবু সাদেক, হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহা, আর আমার আব্বা মারা গেলে সাহাবুদ্দীন কাকু, মনে মনে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েন। দুর্বলতা আর বার্ধক্য যেন তাকে অনেকটাই পেয়ে বসে। একদিন রিকশায় যেতে যেতে কাকু, আমাকে বললেন, এনাম আর পাঁচ বছর যদি সাংবাদিকতা করতে পারতাম। কিন্তু আর বেশিদিন তাঁর সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে থাকা হয়নি। তার ভাই আর ভাগ্নেদের চাপে তিনি ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন।
সাহাবুদ্দীন কাকু যেদিন ঢাকায় চলে যান সেদিন আমি আর সরোজ নুন কাকু তাকে খুলনা রেল স্টেশনে বিদায় জানাতে যাই। ট্রেনে ওঠার আগে তিনি আমাকে কিছু ডায়েরি দিয়ে বলেন, এগুলো তোমার জন্য। আর কয়েকটি পোশাক দিয়ে সরোজ কাকুকে বলেন, সরোজ এগুলো তোমার। কাকু, ঢাকায় চলে যাওয়ার পর আমার আর সরোজ কাকুর সঙ্গে সাহাবুদ্দীন কাকুর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। একদিন সেই সরোজ কাকুও চলে গেলেন। ধীরে ধীরে সাহাবুদ্দীন কাকুর সঙ্গেও যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিছু দিন আগে সাহাবুদ্দীন কাকুর মোবাইল ফোনে রিং দিলে ফোন বন্ধ পাই। তখন একবারও ভাবিনি তিনি কয়েকদিনের মধ্যে ফাঁকি দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে যাবেন অসীমের পথে।
এখন দেখি, অনেক সাংবাদিক বন্ধুরা ছোটখাটো রাজনীতিক আর প্রশাসনের কর্তাদের কাছে কীভাবে ধর্ণা দেন! কিন্তু মাত্র দু’দশক আগেও ছিল এর ভিন্ন চিত্র। সাংবাদিক সাহাবুদ্দীন আহমেদের ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অনেকেই অনেক বড়ো বড়ো পদ অলঙ্কৃত করেছেন। তার ভাইয়েরাও দেশের বড়ো বড়ো রাজনীতিক। কিন্তু সাংবাদিক সাহাবুদ্দীন আহমেদের ব্যক্তিত্বের কাছে তারা অনেকটাই ম্লান। সাংবাদিক হওয়া সহজ কিন্তু ‘সাংবাদিক’ সাহাবুদ্দীন আহমেদের মতো ‘সাংবাদিক’ হওয়া সত্যিই কঠিন।
খুলনা
০৩-০৭-২১
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক