UsharAlo logo
সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এমটিএফই’র ৪০০ সিইওর সন্ধানে গোয়েন্দারা

usharalodesk
আগস্ট ২২, ২০২৩ ১১:১৭ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : দুবাইভিত্তিক ডিজিটাল এমএলএম প্রতিষ্ঠান অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ বা এমটিএফই-এর ৪০০ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সন্ধানে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা।

একই সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট, প্রচারকর্মী, গ্রাহক সংগ্রহকারী, ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছেন-এমন সহস্রাধিক কর্মীর ব্যাপারে অনুসন্ধান করছেন তারা। এছাড়াও এতে প্রায় ১০ হাজার বিনিয়োগকারী বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।

তাদের ব্যাপারেও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সব মিলে এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট থেকে তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, এমটিএফই-এর কর্মীরা দেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে বেশির ভাগ প্রচারণা চালাত। এছাড়া বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে কর্মী নিয়োগ করে তাদেরকে মোটা অঙ্কের বেতন ও কমিশনের প্রলোভন দেখিয়ে প্রচারণার কাজে লাগানো হতো। এর মধ্যে তারা কোম্পানির পক্ষে বিভিন্ন স্থানে প্রচারণাও চালাত। তাদের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী কোনো কর্মী ১০০ জন বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করে দিতে পারলে তাকে সিইও পদবি দেওয়া হয়। সারা দেশে এমন প্রায় ৪০০ সিইও-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এছাড়া তাদের মাধ্যমে ১০ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী রয়েছেন। যারা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। তাদের ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সিইও পদের জন্য অনেকে ফেসবুকে নানাভাবে কোম্পানির পক্ষে প্রচারণা চালাতেন তাদের ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান (মিডিয়া) যুগান্তরকে বলেন, এমটিএফই-এর বিষয়ে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেসব সিইও-এর নাম আসছে, আমরা তাদের নিয়েও অনুসন্ধান করছি। কারা, কীভাবে এই প্রতারণায় ভূমিকা রেখেছে, তা জানার চেষ্টা করছি।

জানা যায়, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) নিজস্ব ডেটাবেজে সোমবার এমটিএফই-এর নামে কোনো লেনদেনের তথ্য রয়েছে কি না, তা অনুসন্ধান করেছে। এতে তাদের নামে বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো নামে তথ্য পাওয়া যায়নি।

কেননা এমটিএফই-এর নামে ব্যাংকগুলো যেমন কোনো তথ্য পাঠায়নি, তেমনই ব্যাংকগুলোয় তাদের নামে কোনো হিসাব আছে কি না, তাও এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে না। কারণ এমটিএফই একটি ডিজিটাল ট্রেডিং সাইট। বাংলাদেশে এদের কোনো নিবন্ধন নেই।

এদিকে সোমবার বিএফআইইউ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। এতে তারা এমটিএফই-এর হয়ে কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেন হয়েছে, এ ব্যাপারে কীভাবে অনুসন্ধান করা হবে তার কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেছে। তারা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে এই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সব ধরনের লেনদেন হয়েছে ডলারে।

এখানে ট্রেডিংয়ে কারেন্সি হিসাবে ব্যবহার হতো ডলার। এই ডলার কিনতে হতো বাংলাদেশি টাকা দিয়ে। পরবর্তীকালে ডলার রূপান্তর হতো ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রায়। বাংলাদেশে যা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। এমটিএফই-এর সঙ্গে জড়িতরা এটিকে একটি হালাল ব্যবসা হিসাবে গ্রাহকদের সামনে তুলে ধরতেন। তারা এটিকে ডলার কেনাবেচার সাইট হিসাবেও পরিচিত করে তোলেন। তথাকথিত ট্রেডিংয়ের নামে এআই রোবটের মাধ্যমে আয়ের পথ উন্মুক্ত করেন তারা।

সোমবার বিএফআইইউ-এর সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মানি লন্ডারিং প্রতিপালন কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে গ্রাহকদের কেওয়াইসি বা গ্রাহকের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, কেওয়াইসি যথাযথভাবে না থাকার কারণে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অনেকে প্রতারণা করে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

কেওয়াইসি ঠিকমতো সংগ্রহ করা হলে জালিয়াতির ঘটনা আগেই আঁচ করা যেত। বৈঠকের একপর্যায়ে এমটিএফই-এর প্রতারণার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। বিএফআইইউ ব্যাংকগুলোর কাছে জানতে চায় তাদের ব্যাংকে এমটিএফই-এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাব রয়েছে কি না। থাকলে তা জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, এমটিএফই-এর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধান করতে বিএফআইইউ থেকে এর সঙ্গে জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, জন্ম নিবন্ধন নম্বর ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমটিএফই-এর সংশ্লিষ্ট অনেকের অবস্থান শনাক্ত হয়েছে।

এমটিএফই-এর মাসুদ নামে অন্যতম একজন মূল হোতা এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ সংক্রান্ত কয়েকটি গ্রুপের ওপর কঠোর নজদারি করা হচ্ছে।

অন্য অনলাইন ট্রেডিং সাইটগুলোর চেয়ে এটি বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে স্থানীয়ভাবে এর কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে। দেশে থাকা চারশর অধিক সিইও এসব কার্যালয় পরিচালনা করতেন।

হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে চলাত তাদের কার্যক্রম। সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করতে আয়োজন করা হতো সেমিনার। কোনো কোনো গ্রুপ ডিজে পার্টির আয়োজন করে গ্রাহক আকৃষ্ট করত। ৩ আগস্ট মিরপুরের মডার্ন কনভেনশন হলে এমন একটি পার্টির আয়োজন করা হয়। সেখানে হিন্দি-বাংলা গানের তালে তালে নৃত্যে মাতেন পার্টির উদ্যোক্তা ও গ্রাহকরা। ওই পার্টির আয়োজক সৌমিক আহমেদ নিজেকে এমটিএফই বিডির অ্যাম্বাসেডর হিসাবে পরিচয় দেন।

ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই)। অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালিত হতো এই কোম্পানিটি। সেখানে বিনিয়োগ বাড়াতে চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) নিয়োগ করা হয়। এই সিইওরা সারা দেশে টিম গঠন করে সেমিনারের আয়োজন করে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করত।

এসব অনুষ্ঠানেই অ্যাপ ইনস্টল করে অনেককে এমটিএফইতে যুক্ত করা হয়েছে। এটি অনেকটা এমএলএম পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হতো। প্রতারণায় অভিনব কৌশল অবলম্বন করে এমটিএফই। এজন্য তারা ‘রেফার সিস্টেম’ ব্যবহার করে। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে রেফার কোড দেওয়া হতো। এই কোড ব্যবহার করে কেউ অ্যাকাউন্ট খুললে যার মূল অ্যাকাউন্টের মালিক বোনাস পেত। আবার নতুন অ্যাকাউন্টের মালিকদেরও এভাবে রেফার কোড দিয়ে বোনাস পাওয়ার সুযোগ ছিল। অ্যাপের ইনভাইট ফ্রেন্ড অপশনে গিয়ে এই কোড নিতে হতো।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমটিএফই মূলত একটি পঞ্জি স্কিম। আর এর চরিত্র হলো শুরুতে পিরামিডের আকার ধারণ করে। পিরামিডের চূড়ায় থাকে লিডার। লিডারের পরিকল্পনা থাকে বড় অঙ্কের টাকা ঢুকলেই তিনি সরে পড়বেন।

সাধারণত এসব কোম্পানি পুরোদমে কার্যক্রম শুরুর পর ৬ মাস থেকে দুই বছর টিকে থাকে। মাস খানেক আগে কাতারে এমন আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা পঞ্জি স্কিমের মাধ্যমে মানুষকে বিনিয়োগ করিয়ে সরে পড়ে। এক্ষেত্রে তাদের টার্গেট থাকে যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী তাদের অনেক প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।

এদিকে এমটিএফই অ্যাপের প্রতারণার বিষয়ে ২৩ জুলাই আইনজীবী জহুরুল ইসলাম রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলার আবেদন করেন। আদালতের বিচারক জিয়াউর রহমান আরজিটি মামলা হিসাবে রেকর্ড করার জন্য নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তদন্তের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনটি সংস্থার তিনজন কর্মকর্তাকে যৌথভাবে এই মামলা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পরদিন মামলাটি থানায় রেকর্ড করা হয়। তবে সেই মামলার তদন্ত খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। তখনও যদি বিষয়টি সামনে আসত, তাহলে হয়তো অনেক গ্রাহকই টাকা উত্তোলনের সুযোগ পেতেন। কারণ, ৭ আগস্ট থেকে গ্রাহকদের অর্থ উত্তোলন সেবা বন্ধ করা হয়। সর্বশেষ ১৭ আগস্ট হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় কোম্পানিটি।

এদিকে বিএফআইইউ থেকে সম্প্রতি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশে অনেক অনলাইন গ্যাম্বলিং, বেটিং বা জুয়া, ট্রেডিংসহ বিভিন্ন ধরনের বেআইনি বিনিয়োগের অ্যাপ বা ওয়েবসাইট রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে দেশে নানা ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য তাদের কাছে সুপারিশ করা হয়।

ঊষার আলো-এসএ