মোতাহার হোসেন : আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যদিয়ে বাঙালি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও ভৌগলিক স্বাধীনতাই অর্জন করেনি। একই সঙ্গে বিশ্বে একটি আত্নমর্যাদা সম্পন্ন জাতি এবং অর্থনীতির সকল সূচকে ইতিবাচক অবস্থানে পৌঁছেছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বিশেষ করে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্বপ্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন তা এখন হাতের নাগালেই। নিজস্ব অর্থায়নে সর্ববৃহৎ স্থাপনা পদ্মা ব্রিজ নির্মাণ আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অন্যতম নির্দশন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এবারে আমাদের বড়ো অর্জন হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি পাওয়া। এই মর্যাদা দেশের জন্য গৌরব ও সম্মানের। তবে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করছে বলে জানানো হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা দিয়ে ‘একশন প্ল্যান’ তৈরি করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থা কিভাবে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে তাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতর পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বার্ষিক চাঁদা বেশি দিতে হবে বাংলাদেশকে। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইস্যুতে ওষুধ শিল্পে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। বেড়ে যাবে ওষুধের দাম এবং এতে রফতানি বাজারও কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহজ শর্তের ঋণ ও অনুদান সহায়তা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। রফতানি পণ্যে ও শিল্পে ভর্তুকি প্রদানের সুবিধা হ্রাস করতে হবে। তবে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণ করা গেলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে দেশের সামনে। বিগত ৫০ বছরের বড়ো এই অর্জনে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ইতোপূর্বে বলেছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি এটাই বড়ো অর্জন। তবে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে দেশের সামনে তা মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকে রফতানিতে জিএসপি প্লাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড়ো বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্ম পরিবেশ এবং মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশ কিছু কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এলডিসি উত্তরণের ‘পলিসি মোট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন’ নামে একটি সুপারিশমালা দিয়েছে জিইডি। এর মধ্যে রাজস্ব নীতি, মুদ্রা নীতি, শিল্প ও বাণিজ্য নীতি, অবকাঠামো খাত উন্নয়ন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর বেশকিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও সুযোগও তৈরি হবে অনেক। সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। এ লক্ষ্যেই পলিসি মোট্রিক্স ফর কপিং আপ উইথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন শীর্ষক একটি সুপারিশমালা তৈরি করা হয়েছে।
এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৈরি করা রোডম্যাপ অনুযায়ী সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজস্ব নীতি- এবং তা বাস্তবায়নের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এটি করা গেলে কর বাড়বে চলতি অর্থবছরে। এবি বর্ধিত কর দাঁড়াবে জিডিপির ১০ শতাংশ। আর ২০৩১ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে জিডিপির ১৫ শতাংশ। এটি বাস্তবায়ন করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। মুদ্রানীতি- প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির দিকে লক্ষ্য রেখে অর্থ সরবরাহ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচেই থাকে। এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা মুদ্রা বিনিময় হার সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ।
এছাড়া এলডিসি উত্তরণে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণ যেন জিডিপির ১৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে। বৈদেশিক ঋণ সেবা যেন মোট রফতানি ও প্রবাসী আয়ের ১০ শতাংশের মধ্যেই থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে নজরদারি করতে হবে। একই সঙ্গে এলডিসির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাংকিং খাতে তদারকি বাড়াতে হবে। সব ব্যাংকের জন্য সমান আচরণ ও সুদ হার নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ চলতি বছরের মধ্যে ৭ শতাংশ বা তার নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এটিও নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি রফতানির প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন নীতি পরিহার করতে হবে। শিল্প ও বাণিজ্য নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি কৌশলপত্র তৈরি করতে হবে। যেটি বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং রফতানি বাড়াতে সহায়ক হবে। বাণিজ্য সংক্রান্ত দক্ষতা উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, বিশেষ করে ২৩টি প্রধান দেশের সঙ্গে এফটিএ’র প্রস্তাব ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি ও পাঠানো শেষ করতে হবে। এর মধ্যে অন্তত দুটি এফটিএ বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে সময়ভিত্তিক একশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে তা জিডিপির ৩২ শতাংশ নিতে হবে। সেই সঙ্গে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ২০২২ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। বিদ্যুত ও জ্বালানি নীতিমালার উন্নয়ন এবং পরিবহণ অবকাঠামো উন্নয়ন নীতিমালা আরো উন্নতও সময় উপযোগী করতে হবে। পরিবহণ খাতের উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পগুলোর দ্রুত এবং সময়মতো বাস্তবায়নে করতে হবে। পাশাপাশি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) নির্ভর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিক পারফর্মেন্স ইনডেক্স-এ ২০৩১ সালের মধ্যে ৬০তম অবস্থানে যেতে হবে। এগুলো বাস্তবায়ন করবে বিদ্যুত-জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়। শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে মানসম্মত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২০৩১ সালের মধ্যে জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি এবং বর্তমান সময়ের উপযোগী শিক্ষার প্রসারে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেজ্ঞ বাংলাদেশের জন্য সমূহ সম্ভাবনা বয়ে আনবে এমন প্রত্যাশাই আমাদের।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জা জার্নালিস্ট ফোরাম।
(ঊষার আলো-এমএনএস)