‘বেঁচে থাকার জন্য কাজ চাই’ অনেকদিন ধরে এমন কিছু লিখতে ইচ্ছে করছিল। তা আর হয়ে উঠেনি। তবে অনেকের কাছে ‘সাংবাদিকতা আর করতে চাই না, বলে বেঁচে থাকার মতো একটা কাজ চেয়েছি। যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে মরতে হয়। সাংবাদিকতা আর ভাল লাগে না।’ আমার সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুরাও আমার এমন ভাবনার কথা জানেন। সত্যিই, এখন বেঁচে থাকার মতো কাজ পেলে এই পেশা ছেড়ে দিতে চাই। রুটি-রুজ্বির নিরাপত্তাহীন এ পেশা আর ভাল লাগে না। এক সময় এই পেশা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, গর্ব করতাম। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এসেছিলাম সাংবাদিকতায়। তাহলে কেন এখন সেই পেশার প্রতি অভিমান বা কষ্ট- এ প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রশ্ন ওঠাটিও স্বাভাবিক। দেশের গড় বয়স হিসেবে এখন মধ্য বয়স পার করছি, তাই পেশা পরিবর্তনতো ঝুঁকির মধ্যেই পড়ে। কিন্তু যখন পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াই, সংবাদের জন্য ছুটে বেড়াই তখন নানা মন্তব্যে মনটা বিষন্ন হয়। নানা রঙ আর ঢঙের সাংবাদিকতা দেখতে দেখতে হতাশ হই। অথচ কত আশা নিয়েই এই পেশায় এসেছিলাম, আজ এ কী দেখছি! আবার হতাশার মধ্যেই আলো দেখি, ‘সম্মাননা স্মারকের স্বর্ণ চুরি’, ‘বিরল ভালবাসা’, ‘বালিশ কাণ্ড’, ‘জুয়া কাণ্ড’, ‘সাহেদ-সারমিন কাণ্ড’, সার্টিফিকেট জালিয়াতি’, ‘মানব পাচার’, ‘মাদক ব্যবসা’, ‘উপাচার্য নিয়োগ বাণিজ্য’র মতো শত শত সারা জাগানো রিপোর্ট আমাদের সাংবাদিকতারাই তুলে আনেন। এসব আলোকিত প্রতিবেদন আশা জাগায়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।
সত্যিই বড় বিষন্ন আর কঠিন সময় পার করছে পেশাদার সাংবাদিকতা। আলোচিত অনেক সংবাদের কারিগর পেশাদার সাংবাদিকরা হারিয়ে যাচ্ছেন, পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন চাটুকার, সুবিধাবাদীদের জয় জয়কার চলছে। পেশাদার সাংবাদিকতা প্রতিনিয়ত নানা খড়গের সম্মুখিন হচ্ছে। সত্য প্রকাশের জন্য একদিকে হুমকি-দমকি, হয়রানি, নির্যাতন, অন্যদিকে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এমনই হয়রানি নির্যাতনের সর্বশেষ (১৭ মে, ২০২১) শিকার দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম। স্বাস্থ্য দপ্তর, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের মুখোশ উম্মোচনকারী এই সাংবাদিক এখন ‘চোর’ হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছেন। রোজিনা ইসলামকে শায়েস্তা করতে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে মত বছর আগের (১৯২৩ সালে) ব্রিটিশদের সৃষ্টি করা ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’। স্বাস্থ্য দপ্তরে দীর্ঘ ৬ ঘন্টা স্বনামধন্য এ সাংবাদিককে আটকে রেখে শারীরিক-মানষিক নির্যাতন করা হয়। সংবিধানে প্রদত্ত সাধারণ নাগরিকের প্রাপ্য সকল অধিকার লঙ্ঘন করার পর উল্টো রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ‘নথি চুরি’র অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অন্যায় ঘটনায় সারাদেশের হাজার পেশাদার সাংবাদিক, সাধারণ ও সচেতন মানুষ প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নানা কর্মসূচিতে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। শর্ত সাপেক্ষে ৯দিন পর জামিন মিলেছে রবিবার (২৩ মে)। কিন্তু ঘটনার কুশীলবরা এখনও অন্তরালে রয়েছেন।
রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের করা উপনেবেশিক আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো নিষিদ্ধ এলাকা ও সরকার ঘোষিত কোনো এলাকা সম্পর্কীয় কোনো গোপনীয় অফিসিয়াল কোড বা পাসওয়ার্ড বা কোনো স্কেচ, প্ল্যান, মডেল, আর্টিকেল, নোট, দলিলপত্র অথবা তথ্য কোনো ব্যক্তি আইনসঙ্গত দখলে বা নিয়ন্ত্রণে রেখেও যদি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করে, যদি অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্যাদি অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্র ব্যবহার করে, তাতে সেই ব্যক্তি অপরাধী হবে।’ এই আইনটি তখন করা হয়েছিল, ব্রিটিশদের অখন্ডতা রক্ষার জন্য। স্বাধীনতাকামীদের দমনের জন্য। পরবর্তীতে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের দমনে ওই আইনের সাথে সাময়িক ধারা সংযুক্ত করে দমন-পীড়ন শুরু করেছে। কিন্তু কোনভাবেই স্বাধীনমতকে দমাতে পারেনি। আজ প্রায় একশ’ বছর পর যারা এই আইনকে আবার টেনে আনলো শুধু তারাই বলতে পারবেন, তাদের উদ্দেশ্য কী। কেনই বা তারা ফের একশ বছর পিছিয়ে গেলেন।
সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা ও প্রকৃত সাংবাদিকরা কোনকালেই নিরাপদ ও সুরক্ষিত ছিলেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও সাংবাদিকরা কম নাজেহাল হয়নি। এর আগে বিএনপি-জামাত, চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও সাংবাদিকদের ওপরে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, মাদক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সকলেরই আতংক প্রকৃত সাংবাদিকতা। তাই ঘটনা বা খবর কারও পক্ষে গেলে তারা সাংবাদিকদের পক্ষে থাকেন, আবার বিপক্ষে গেলে সাংবাদিকের গোষ্ঠী তুষ্টি করেন। আমরা স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী পার করলেও আজ পর্যন্ত এদেশের সাংবাদিকদের জন্য কোন সুনিদিষ্ট যেমন নীতিমালা তৈরী হয়নি, তেমনি সাংবাদিক নামক পেশার সুরক্ষা হয়নি। আর এ সুযোগে মহান পেশাটি কতিপয় দুষ্ট মানুষের রাজনৈতিককরণ ও দুর্বৃত্তায়নের শিকার হচ্ছে। আর রোজিনা ইসলামদের মতো সাংবাদিকতার পথ সংকুচিত হচ্ছে। যে কোন ঘটনায় রাজনৈতিক রূপদান প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
আমাদের সমস্যার শেষ নেই। বাংলাদেশ আজ নানা ক্ষেত্রে বিশ্বে ঈর্ষনীয়। এ ঈষনীয়তার পিছনের নায়ক আমাদের দেশের খেটে খাওয়া মানুষ কৃষক-শ্রমিক আমজনতা। আর এ খেটে খাওয়ার মানুষের রক্ত চুষে খাওয়া ধনী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কোটি টাকা, হাজার কোটি টাকার মালিকের সংখ্যা আমাদের দেশে নেহাত কম নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে দেখাগেছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারী হিসাবের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি। এর মধ্যে কোটি টাকার উপরে রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৩ দশমিক ১৬ শতাংশই কোটিপতিদের দখলে। কোটিপতি এই তালিকায় শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, আছেন আমলা, রাজনীতিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষ।
দেশের মধ্যবিত্ত মানুষগুলো সবচেয়ে বিপদাপন্ন। তারা দিন আনে দিন খায় অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না। দিন দিন তারা ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। নানা সংকটে পড়ছে। সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনায় অর্থনীতির হিসেব-নিকেশ হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু সবকিছুর পিছনেই রয়েছে অর্থনীতি। আজকের লুটপাট, দুর্নীতি ও অনিয়ম ওই অর্থকে ঘিরেই। আজকাল কতিপয় আমলা নিজেদের সর্বক্ষমতার অধিকারী মনে করেন। নিজেদের প্রভু মনে করেন। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাদের ভূমিকা সেবাদাতার হলেও তারা কেউ কেউ তা মনে করেন না। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে নানারূপ ধারণ করেন। তারা তাদের প্রয়োজনে একটি গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও তুষ্ট করেন। এ ক্ষেত্রে ফরমায়েশী সাংবাদিক গোষ্ঠীর ভূমিকা কম নয়। এই গোষ্ঠী তাদের গুনকীর্তণে ব্যস্ত থাকেন। মাঝে মাঝে উচ্ছিষ্টভোগ করেন- এমন চিত্র গোটাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের। তাই এইসব ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে সরকার বা রাষ্ট্র বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও তারা সহসা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হন। এই গোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশী ভয়, ‘প্রকৃত সাংবাদিক’। তাই তারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা রুখতে চায়, নানা জালে বন্দী করতে চায়। এই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টও সেই কৌশলের অংশ।
প্রকৃত সাংবাদিকতা মানে ‘তথ্য চুরি’। সাংবাদিকরা তাদের কৌশল, বুদ্ধি ও মেধা খাটিয়ে গোপন তথ্য সাধারণ মানুষের সামনে তুলে আনেন। অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাটের চিত্র যেমন সামনে আনেন। আবার উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রও তুলে ধরেন। সাংবাদিকতা শুধু নেতিবাচক সংবাদ নয়, ইতিবাচক সংবাদও। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মূলকথা, সত্য ও প্রকৃত ঘটনা আড়াল থেকে সামনে আনা। যাতে দেশ-দেশের মানুষ উপকৃত হন। সমাজের বৈষম্য, অনিয়মের অবসান ঘটে। মানুষের সচেতনতা বাড়ে। আজ যারা লুটপাট করবে, দুর্নীতি করবে, অনিয়ম করবে; নিশ্চয় তারা চাইবে না গোপন বিষয়টি উম্মুক্ত হোক। মানুষের সামনে আসুক। সেখানেই অনুসন্ধান সাংবাদিকতা, প্রকৃত সাংবাদিকতা। হত্যা, হুমকি ও হাজারো নিপীড়নের পরও যুগে যুগে এমন সাংবাদিকতার জয় হয়েছে। জয় হবেই।
একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী হিসেবে মনেকরি, তথ্য চুরি ছাড়া প্রকৃত সাংবাদিকতা হবে না। যেটি হবে সেটি ‘ফরমায়েশী সাংবাদিকতা’ (পেইড জার্নালিজম), উচ্ছিষ্ট ভোগ করা যাবে। সেই সাংবাদিকতা হয়তো সচেতন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোন মানুষই করতে চাইবে না। তাই ‘তথ্যচোর’ হতেই হবে। তথ্য চুরি করতে হবে; প্রকৃত চোরদের মুখোশ উম্মোচনের জন্য, রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের জন্য।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা শুধু তাঁর শর্ত সাপেক্ষ জামিনের মধ্য দিয়ে শেষ হবেনা। যারা নিজেদের দুর্নীতি ঢেকে রাখতে দেশকে শতবছর পিছনে ঠেলে দিচ্ছে তাদের স্বরূপ খুলতে হবে। দলবাজ বা ফরমায়েশী সাংবাদিক নয়, প্রকৃত পেশাজীবী সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দ্বিধা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে অবাধ তথ্য প্রবাহের পক্ষে বাধা হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিলের দাবি জোরালো করতে হবে। দাবি জানাতে হবে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা পেশা সুরক্ষা আইন, সাংবাদিকতার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের। যতদিন পর্যন্ত সাংবাদিকরা নিজ ভিত্তির ওপরে দাঁড়াতে না পারবেন, ততদিন এমন নির্যাতন, হয়রানি, অপবাদের শিকার হতে হবে।
লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা; দৈনিক কালের কণ্ঠ।