ঊষার আলো রিপোর্ট : বাজেট প্রস্তাবে সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, এটি কাল্পনিক ও অবাস্তব বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার যে কৌশল নিয়েছে, তা বরং মূল্যস্ফীতি আরো বাড়াতে পারে। এটি সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার বেশ চড়া।
২০২২ সালের নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি একলাফে ৮.৮৫ শতাংশে চলে আসে। চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলে এই মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। মূল্যস্ফীতি দিয়ে মূলত পণ্যের দাম বাড়ার গতি-প্রকৃতিকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূলত সারা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মূল্যস্ফীতির হিসাব দিয়ে থাকে।
গত শুক্রবার বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরাও শঙ্কিত। সারা বিশ্বেই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে আমরা খাবার তো বন্ধ করতে পারব না।
একটা নমনীয় পথে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি (মূল্যস্ফীতি) হয়, তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। প্রয়োজন অনুযায়ী ছাড়ও দিচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাজেটে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে, পাঁচ বছর ধরেই তা জানিয়ে আসছি। আমরা ব্যর্থ হইনি।ভবিষ্যতেও ব্যর্থ হব না।’
সংবাদ সম্মেলনে মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে তেল, চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও নিত্যপণ্যের দামে কোথাও কোথাও মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার একটি সংকটময় মুহূর্তে বাজেট দিয়েছে, যে সময় মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯.২৪ শতাংশ। এ রকম অবস্থায় সরকার কিভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখবে তা আমার বোধগম্য নয়। এ ছাড়া সরকার মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যেসব কৌশল নিয়েছে, তা বরং মূল্যস্ফীতিকে বাড়াতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নসহ অন্য যেসব কর্মপরিকল্পনা দেখছি, সেখানে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল নেই। সরকার বলেছে এটি গরিববান্ধব বাজেট, কিন্তু তারা পদক্ষেপ নিয়েছে উল্টো। এই বাজেট পাস হলে বরং গরিবসহ মধ্যবিত্তরা চাপে পড়বে।’
বিবিএসের তথ্য বলেছে, সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৮৬ শতাংশ। এর পরেই নভেম্বর মাসে এক লাফে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮.৮৫ শতাংশে আসে। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয় ৮.৭১ শতাংশ। চলতি বছরের শুরু থেকে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ শতাংশের ওপর। জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি হয় ৮.৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৮.৭৮ শতাংশ, মার্চে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘর পেরিয়ে দাঁড়ায় ৯.৩৩ শতাংশ। সর্বশেষ এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯.২৪ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ বাজেটে ঘোষণা করেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের সবচেয়ে দুর্বলতম দিক এটিই। অথচ দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি। যার প্রভাব সরাসরি মানুষের ওপর পড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিপি) বলেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা, তা পূরণে ব্যর্থ এ বাজেট।
তারা বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও বিনিয়োগ সূচকের ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তবতার তেমন মিল নেই। দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বাস্তবতা স্বীকার না করে এ ধরনের অনুমিতি বা প্রক্ষেপণের দুর্বলতার কারণে পরে বাজেট বাস্তবায়ন হোঁচট খাবে। তাতে শেষ পর্যন্ত হয়তো এসব লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নও হবে না।
তারা বলেছে, সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে টাকা ছাপাতে পারে। বরং তা হিতে বিপরীত হতে পারে। নতুন টাকা ছাপা হলে তা টাকার মূল্যমানকে আরো কমাবে এবং মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন পূরণে সরকার আগামী অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ধার নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। অনেক ব্যাংক তারল্যসংকটে ভুগছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার বাস্তবতা কম। সরকারের ব্যাংকঋণের বড় অংশই নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বড় অসুবিধা হচ্ছে, এ ধরনের ধার মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার এখন যেভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে, তাতে খুব বেশি সমস্যা হয়তো হচ্ছে না। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এ কারণে টাকার সরবরাহে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে কী হবে? আগামী বছর আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। রিজার্ভ বাড়াতে হলে ডলার কিনে বাজারে টাকা ছাড়তে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তখন সরকার যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয়, তাহলে তা মূল্যস্ফীতিকে আরো বেশি উসকে দেবে।
তিনি বলেন, ‘টাকার মান কমার যে প্রবণতা রয়েছে, সেটি অব্যাহত থাকলে সামনের দিনে মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলবে এবং এই মূল্যস্ফীতি সরকারের একটা মাথাব্যথার কারণও হতে পারে।’
ঊষার আলো-এসএ