রবীন্দ্র দর্শনের উচ্চতা ও গভীরতা পরিমাপ করার ক্ষমতা আমার আছে বলে আমি মনে করি না। তথাপি কবিগুরুর বিভিন্ন কবিতা, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি পড়ে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তাঁর মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি যেটুকু অনুধাবন করতে পেরেছি তাই আজকের আলোচ্য বিষয়।
কবিগুরু যে পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তার একটা প্রভাব তাঁর শিক্ষা দীক্ষার মধ্যে ছিলো। ঠাকুর পরিবার ছিলো ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। ব্রাহ্মরা একেশ্বরবাদী ও নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী। এই ধর্মের ইতিহাস ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে চাই। সনাতন ধর্মের উদারতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে অসংখ্য মতাদর্শ ধীরেধীরে গড়ে ওঠে এবং ঐ সমস্ত মতাদর্শের মধ্যে তিক্ত বিরোধ ও সংঘর্ষ বিভিন্ন সময়ে লক্ষ করা যায়, যার মূলে ছিলো ধর্মীয় আচার ও যাগযজ্ঞের পার্থক্য। এছাড়া ছিলো শাস্ত্রের ভারে ভারাক্রান্ত শাস্ত্রীগণের কট্টর মনোভাব। অসংখ্য শাস্ত্র নিয়ে গঠিত বৈদিক গ্রন্থাগার মুখ্যতঃ তিনটি ভাগে বিভক্ত, যথাঃ শ্রুতি প্রস্থান, স্মৃতি প্রস্থান ও ন্যায় প্রস্থান। এই ন্যায় প্রস্থানের অন্তর্গত হলো ষড় দর্শন। ষড় দর্শন হলোঃ ন্যায়,বৈশেষিক, সাংখ্য, পাতঞ্জল, পূর্বমীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা । পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা সম্পূর্ণরূপে বেদমূলক। উত্তর মীমাংসা হলো বেদান্ত দর্শন তাকে আবার ব্রহ্মসূত্রও বলা হয়। ঋষি ব্যাসদেব ওরফে বাদরায়ণ এই ব্রহ্মসূত্রের প্রণেতা। ব্রহ্মসূত্রকে বোধগম্য করার জন্য এর বিশদ ভাষ্য রচনা করেন মহর্ষি শংকারাচার্য । তার মতে ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয় । ব্রহ্ম সমস্ত বিশ্বে পরিব্যাপ্ত থাকলেও সবকিছু শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মেই লীন হয়। শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। পরমাত্মা ও জীবাত্মা অভিন্ন। এই হলো শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ।
বেদান্ত দর্শনের আরেকজন ভাষ্য রচনাকারী হলেন রামানুজ। তিনি সামান্য দ্বিমত পোষণ করে বললেন যে, পরম ব্রহ্মই বিশ্বের সার। জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ বিশেষ। তবে জীব ও দৃশ্যমান জগত উভয়ই সত্য, তা মায়া নয়। এই হলো রামানুজের ” বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ”।
হিন্দু দর্শনের শাস্ত্র নিয়ে এই পর্যন্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হলো এই “বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদের” পরম্পরা কী তা বুঝতে চেষ্টা করা। এই তত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রামানন্দ, কবির, গুরু নানক, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু , দাদু ও রাজা রামমোহন রায়। “বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ” তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হিন্দুদের ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা রোধ, ধর্মের আধুনিকায়ন ও সুরক্ষার জন্য তাঁর এই প্রয়াস ছিলো। তিনি আধুনিক ভারতের প্রবক্তা ও সনাতন ধর্মের অন্যতম সংস্কারক। তারপর বিদ্যাসাগর মহাশয় ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার এই ব্রাহ্ম সমাজের উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক ধর্মীয় মনোভাব সুস্পষ্ট করার জন্য এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন ছিলো বলে মনে করি। তাই রবি ঠাকুরের মানসপটে উপনিষদের দর্শন বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও ধর্মের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শনে তিনি ছিলেন নিস্পৃহ। ঈশ্বরের স্বরূপ উদঘাটন করতে চেষ্টা করেছেন তিনি সারাজীবন। কিন্তু কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। এ ব্যাপারে নীচের কবিতাটি সেই অপূর্ণতার সাক্ষ্য বহন করে।
” প্রথম দিনের সূর্য ”
—————————–
” প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নতুন আবির্ভাবে-
কে তমি?
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিম সাগর তীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-
কে তুমি?
পেল না উত্তর।”
মৃত্যুর সাত দিন আগে কবি মুখে মুখে আরেকটি কবিতা বলেছিলেন। এটিই তাঁর শেষ কবিতা-
” তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী! ”
অলৌকিক কোনো ঈশ্বরে তাঁর সুদৃঢ় বিশ্বাস কখনো আসেনি। রবি ঠাকুরের ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পূর্ণ উপনিষদের মধ্যে নিহিত ছিলো। উপনিষদ অনুসারে ঈশ্বর হলো “সচ্চিদানন্দ “। রবি ঠাকুরও ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দ বলে মনে করেছেন। শক্তি, চৈতন্য বা জ্ঞান ও আনন্দ এই তিনে মিলে হয় সচ্চিদানন্দ। ঈশ্বর শক্তিময়, জ্ঞানময় ও আনন্দময়। শক্তি ও জ্ঞানের প্রয়োজন আনন্দ প্রাপ্তির জন্য।
তাই তিনি লিখলেন-
” জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ
ধন্য হলো ধন্য হলো মানব জীবন।”
তিনি সহমত পোষণ করেছিলেন উপনিষদের নিম্নরূপ বাণীতেঃ
” আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি
আনন্দং প্রয়স্ত্যভিসংবিশন্তি।”
অর্থাৎ সর্বব্যাপী আনন্দ থেকেই সকল প্রাণী জন্ম গ্রহণ করে, আনন্দের মধ্যে জীবিত থাকে ও আনন্দের মধ্যে গমন করে।
ধর্মের সরল আদর্শ প্রবন্ধে রবি ঠাকুর উপনিষদের এই বাণী প্রসঙ্গে লিখেছেন- ” ঈশ্বর সম্মন্ধে যত কথা আছে, এই কথাই সর্বাপেক্ষা সরল, সর্বাপেক্ষা সহজ। ব্রহ্মের এই ভাব গ্রহণ করিবার জন্য কিছু কল্পনা করিতে হয় না, দূরে যাইতে হয় না, দিনক্ষণের অপেক্ষা করিতে হয় না – হৃদয়ের মধ্যে আগ্রহ উপস্থিত হইলেই হয়।”
আরেক জায়গায় তিনি বললেন- ” ধর্মের সরল আদর্শ একদিন আমাদের ভারতবর্ষেরই ছিল। উপনিষদের মধ্যে তাহার পরিচয় পাই। তাহার মধ্যে যে ব্রহ্মের প্রকাশ আছে তাহা পরিপূর্ণ, তাহা অখন্ড, তাহা আমাদের কল্পনা-জাল দ্বারা বিজড়িত নহে।”
এতক্ষণের আলোচনায় এটা স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হলো যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দুদের অন্যতম শাস্ত্র উপনিষদের প্রতি আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বেদান্তের রামানুজ ভাষ্যের ন্যায় “বিশিষ্ট- অদ্বৈতবাদী”। তাঁর অদ্বৈতবাদ নীচের কবিতায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
” সীমার মাঝে অসীম তুমি
বাজাও আপন সুর
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাইতো এতো মধুর।”
সীমাবদ্ধ মানব দেহে জীবাত্মারূপে অসীম পরমাত্মার অধিষ্ঠান। তাই জীবন এতো সুন্দর। জীবাত্মা পরমাত্মার অংশ যা আবার পরমাত্মায় ফিরে যায়।এখানে কোনো দ্বৈত সত্তা নেই। যা পরমাত্মা, তাই জীবাত্মা। এই হলো বেদান্ত দর্শনের অদ্বৈতবাদ। রবি ঠাকুর অদ্বৈতবাদী তা উপরের কবিতা থেকে বুঝা গেল।
ব্রাহ্ম সমাজের লোকেরা একেশ্বরবাদী ও নিরাকার উপাসনায় বিশ্বাসী। কিন্তু রবি ঠাকুর দেখলেন- ” মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ীরূপ”। মাটীর তৈরী আধারে চিত্ত বা চেতনাময় রূপ দেখে আত্মহারা তিনি। সাকার উপাসনায় কত বড় সমর্থন দিলেন তিনি একবার ভেবে দেখুন।
গীতায় কর্মকে মহান করার তিনটি উপায় বলা হয়ছে। প্রথমটি হলো অহমিকা পরিত্যাগ, দ্বিতীয়টি হলো- ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন ও তৃতীয়টি হলো আত্মসমর্পণ। রবি ঠাকুর এই তিনটি মহান বাণীকে তাঁর কবিতায় নিয়ে এসেছেন। “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে, সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।” অহমিকা পরিত্যাগের বাণী এখানে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। “কৃপণ” কবিতায় আত্মসমর্পণের কাহিনী চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর কর্মনিষ্ঠার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন তিনি বহু কবিতায়। “ধুলামন্দির” কবিতায় বললেন-
‘ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পড়ে।
রাখো রে ধ্যান, থাক্ রে ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি–
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে ঘর্ম পড়ুক ঝরে।’
কর্মযোগের মূল দর্শনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে এই কবিতায়। গীতা দর্শনের প্রতি তিনি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ” বৈরাগ্য” কবিতায় তিনি বলেছেন কর্মেই তোমার অধিকার, কর্ম ত্যাগে কখনো নয়। সংসার বিবাগীকে সংসারে ঈশ্বর খুঁজতে বলেছেন তিনি। বিবেকের বাণী শুনতে না পেয়ে যখন ভক্ত সংসার ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে, তখন ঈশ্বরের আক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে ” বৈরাগ্য” কবিতায় –
” দেবতা নিশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, হায়,
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়!”
হিন্দু দর্শনের অন্যতম মৌলিক উপাদান হলো জন্মান্তরবাদ। এ ব্যাপারে কবির ” জন্মান্তর” কবিতাটি আমরা একটু পড়ে দেখি-
“আমি ছেড়েই দিতে রাজী আছি
সুসভ্যতার আলোক,
আমি চাই না হতে নববঙ্গে
নবযুগের চালক।
যদি পরজন্মে পাই রে হতে
ব্রজের রাখাল বালক।
তবে নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে
সুসভ্যতার আলোক।।
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে,
যারা গুঞ্জাফুলের মালা গেঁথে
পরে পরায় গলে,
যারা বৃন্দাবনের বনে
শ্যামের বাঁশি শোনে,
যারা যমুনাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে
শীতল কালো জলে।
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে।।
হেরো আঙিনাতে ব্রজের বধূ
দুগ্ধ দোহন করে
ওরে, বিহান হলো জাগরে ভাই
ডাকে পরস্পরে।
আমি কোনো জন্মে পারি হতে
ব্রজের গোপবালক,
তবে চাই না হতে নববঙ্গে
নবযুগের চালক।। ”
কবিতাটি পড়ার পরে কবির জন্মান্তর বিষয়ক ধারণাটি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি বৃন্দা- বনের রাখাল বালক শ্রী কৃষ্ণের প্রতি তাঁর দুর্বার আকর্ষণ এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা কবিতার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে।
অবতারবাদ হিন্দু ধর্মের আরেকটি মৌলিক বিশ্বাস। এই অবতার বিষয়ে কবিগুরুর একটি কবিতা এখানে তুলে ধরা হলো।
‘ প্রশ্ন’
” ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত
পাঠায়েছ বারেবারে
দয়াহীন সংসারে। ”
ভগবানের দূত পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন তা তিনি বিশ্বাস করেছেন। তিনি বৃন্দাবনের রাখাল বালক, শ্রীকৃষ্ণ হতে চেয়েছেন। গীতার মৌলিক সকল তত্ত্বের প্রতি তিনি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। গায়ত্রী মন্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তাঁর রচিত “ধর্মের সরল আদর্শ” প্রবন্ধে।
সবশেষে রবি ঠাকুরের ” চরম মূল্য” কবিতার সারাংশ গদ্যরূপে তুলে ধরছি। একজন বণিক তার পসরা সাজিয়ে বলে বেড়াচ্ছে – ” কে নিবি গো কিনে আমায়,
কে নিবি গো কিনে।”
মাথার উপর পসরার বোঝা ভীষণ ভারী হয়ে গেছে। তবুও পথে প্রান্তরে হেটে হেটে বিক্রয় করে বেড়াচ্ছে পসরা বিক্রেতা । এক সময় রাজার সাথে দেখা। তিনি বললেন- “আমি রাজা, কিনব আমি জোরে।
শেষে জোর যা ছিল ফুরিয়ে গেল
টানাটানি করে।”
রাজা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেল। তারপর টাকার থলি নিয়ে এলো এক বুড়ো। বিবেচনা করে বললে-
” কিনব দিয়ে সোনা।
উজাড় করে দিয়ে থলি
করলে আনাগোনা।”
পসরাওয়ালা তখন হলো অন্যমনা।
তাই বিক্রয় হলো না।
তারপরে সন্ধ্যাবেলা এলো এক সুন্দরী, কিনতে চাইলো হাসির বিনিময়ে।
”হাসিখানি চোখের জলে মিলিয়ে এল শেষে।
ধীরে ধীরে ফিরে গেল বনছায়ার দেশে।”
সবশেষে বালুতটে ক্রীড়ারত শিশু নিল তাকে চিনে, বললে-
” অমনি নেব কিনে–
বোঝা আমার খালাস হল তখনি সেই দিনে।
খেলার মুখে বিনামূল্যে নিল আমায় কিনে।।”
ভালোবাসা দিয়ে বিনা মূল্যে কেনার তত্ত্ব এখানে বলা হয়েছে। জোর দিয়ে হলো না, অর্থের বিনিময়ে হলো না, রূপ মাধুরী দিয়ে হলো না। হলো শিশুর ভালোবাসা দিয়ে যা বিনিময় মূল্য প্রত্যাশা করে না। এই হলো সনাতন ধর্মের অহৈতুকী ভাব। ভাগবতীয় প্রেম ও ভালবাসার জয়গান। প্রস্থানত্রয়ীর পরে এই হলো চতুর্থ প্রস্থানের মর্মবাণী । এখানে কোনো চাওয়া পাওয়ার সম্পর্ক নেই। শুধু ভালেবাসা দেওয়া ও ভালোবাসা পাওয়া। ভাগবতের উপাখ্যানে ভক্ত প্রহ্লাদ ভক্তির বিনিময়ে কোনো বর নিতে রাজী হননি। তিনি বলেছিলেন, ভক্তির বিনিময়ে বর চেয়ে নেয়া এক ধরনের বাণিজ্য। তার উক্তি —
” ন ধনং ন জনং ন সুন্দরী
কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে তব
ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ী।”
অর্থাৎ আমি ধন,জন, সুন্দরী স্ত্রী কিছুই চাই না। শুধু এই চাই, যুগে যুগে তোমার উপর যেন আমার অকারণে ভক্তি থাকে। এই হলো সনাতন ধর্মের মাহাত্ম্য যেখানে ভগবানের সাথে লেনদেনের কোনো সম্পর্ক নাই। সচ্চিদানন্দরূপ ঈশ্বর শক্তিময়, ঈশ্বর জ্ঞানময়। আবার ঈশ্বর আনন্দময়। সেই আনন্দময় ঈশ্বরের স্বরূপ প্রকটিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের বাল্য লীলায়, ব্রজলীলায়। সবশেষে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন বাংলার ভক্তকূলকে। শ্রী কৃষ্ণ অস্ত্র হাতে ঈশ্বরের শক্তিময় রূপ দেখিয়েছেন বহুবার। কুরুক্ষেত্রে বিনা অস্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন তিনি রথের সারথী হিসেবে। বিনা অস্ত্রে যুদ্ধ জয় করে তিনি ঈশ্বরের জ্ঞানময় রূপ দেখালেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে তিনি সুদর্শন চক্র পরিত্যাগ করেন। তিনি পুনরায় বাঁশি হাতে নিলেন। প্রেমের প্রতীক বাঁশি দিয়ে শান্তি স্থাপনের জন্য সনাতন ধর্মের চতুর্থ প্রস্থান হলো রস প্রস্থান। রস প্রস্থান হলো ভাগবত। এই ধাপে এসে ভগবানকে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছে মানুষের সামনে। এই ঈশ্বরকে ছুঁয়ে দেখা যায়, ভালেবাসা যায়, আদর করা যায়। ঈশ্বর প্রেম দিতে ও প্রেম নিতে মানুষের মাঝে অবতীর্ণ। হিন্দু দর্শনের সর্বশেষ স্তরটি হলো এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক একেশ্বরবাদ। ঈশ্বর এখানে প্রেমময়। ভাগবতে পঞ্চ রসের সমাহার দিয়ে এই প্রেমকে পরিস্ফুট করে তোলা হয়েছে । শান্ত রস, বাৎসল্য রস, দাস্য রস, সখ্য রস ও মধুর রস এই হলো ভাগবতের পঞ্চ রস। ভাগবতে অপূর্বভাবে এই রস সমূহের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। এই রস সমূহ নিয়ে পরবর্তী সংখ্যায় আলোচনা করা হবে।
লেখক: প্রশান্ত কুমার রায়, সদস্য, ট্যাক্সেস এপিলেট ট্রাইব্যুনাল, বেঞ্চ-৪, ঢাকা।