UsharAlo logo
শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তাহসিনা সফল হলে হাসবে বিশেষ শিশুরা

usharalodesk
এপ্রিল ৩০, ২০২৪ ৩:১৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : আমার জন্ম চট্টগ্রামে, যদিও সেখানে খুব বেশিদিন থাকা হয়নি। বাবা ছিলেন বিচার বিভাগে, অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে অবসর নেন। মা বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার। সেই সুবাদে ১৯৮৬ সালের দিকে আমরা ঢাকায় চলে আসি।

তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি মেজো। প্রথম শ্রেণি থেকেই ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়েছি। আপু একই স্কুলের ছাত্রী। এখন তিনি শিশু বিশেষজ্ঞ।ছোট ভাইও ডাক্তার।

ভিত গড়ে দিল বিদ্যালয়

প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে সেরা তিনের মধ্যে থাকত আমার নাম। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাচ, বিতর্কসহ স্কুলের প্রায় সব কিছুতেই অংশ নিতাম।

শৈশবে নজরুল একাডেমিতে নাচও শিখেছি বছর চারেক। পরে নাচের চর্চা আর করিনি। অবশ্য এখনো ছবি আঁকি, যদিও এ বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আসলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে তৈরি হওয়া সেই আনন্দের জগতে এখনো আমার বিচরণ। প্রচুর গান শুনতাম।
অঞ্জন দত্তের গান আর গানের পেছনের গল্প আমাকে এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যেত। আমার পরিবারও ছিল খুব ছিমছাম, পরিপাটি।

বুয়েটে পড়তেই হবে

একসময় ভাবতাম, নিজের একটি ব্যান্ডদল থাকবে, সেখানে গিটার বাজাব। আবার স্কুলের স্যারদের দেখে ভাবতাম, তাঁদের মতো হব। তবে নবম শ্রেণির আগ পর্যন্ত ডাক্তার হব, এটিই ছিল পণ। একবার এক বিজ্ঞান মেলায় বুয়েটের এক ভাই এলেন, যিনি অসাধারণ কনসেপ্টে কুইজের প্রশ্ন করতেন। উনাকে দেখেই প্রথম বুয়েট সম্পর্কে জানলাম। তখন মনে হলো বুয়েটে পড়তেই হবে। কলেজে একবার বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সহসম্পাদক হলাম। সেখানকার একটি ফিচারের জন্য বুয়েটে গেলাম ইইই বিভাগের কয়েকজন বড় ভাইয়ের কাছে। তাঁরা তখন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের জন্য বুয়েটের শিক্ষকদের সঙ্গে কাজ করছিলেন। সেটি ছিল জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ল্যাবে ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে দেখলাম নিজের চোখে। এভাবে কাজ হয় জানতাম না। এত ভালো লাগল যে মনে হলো বুয়েটে না পড়লে সব বৃথা।

সেই বুয়েটের শিক্ষক

বুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগে ভর্তি হলাম ২০০৩ সালে। বুয়েটে পড়তে পড়তেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। অধ্যবসায় আর হার না মানা মনোবলের কারণে সেই স্বপ্ন মুঠোয় ধরা দিল। ২০১১ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্রপ্রিয়েট টেকনোলজিতে (আইএটি)। মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরপরই।

এখন গবেষণাকর্ম নিয়েই মেতে আছি। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের অ্যাপলিকেশন নিয়ে। আইএটির প্রাথমিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে স্নাতকোত্তর প্রগ্রাম অফার, শিল্পকর্মীদের জন্য সংক্ষিপ্ত কোর্স ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা, প্রযুক্তির চাহিদা এবং নীতিগুলো মোকাবেলায় গবেষণা ও উন্নয়নে মনোনিবেশ করা। আমাদের ইনস্টিটিউট উচ্চমানের শিক্ষা, গবেষণা এবং আউটরিচ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই আমার গবেষণাও দেশীয় লাগসই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে এখন কাজ করছি অটিজম শনাক্তকরণ, স্মার্ট টোল ম্যানেজমেন্ট, ই-কমার্স ম্যানেজমেন্ট, স্মার্ট বিল্ডিং এনার্জি ম্যানেজমেন্ট এবং ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

বিষণ্ন মুখগুলো দেখে খারাপ লাগে

পিএইচডি করে ফেরার পর গবেষণাকে কিভাবে দেশের কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে ভাবতে থাকলাম। আমার ছেলে যে স্কুলে পড়ে, সেখানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদেরও আলাদা শাখা আছে। সেখানে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা পড়ে। ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসার সময় সেসব শিশুকে দেখতাম। তাদের অভিভাবকদের পর্যবেক্ষণ করতাম। সেই মা-বাবাদের চেহারায় যে গভীর বিষণ্নতা দেখেছি, সেটি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তখন অটিজম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। দেখলাম, এখানে আমাদের মতো এআই গবেষকদের অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। ধীরে ধীরে আমার পিএইচডির গবেষণাকে এই খাতে সম্প্রসারণ করার অ্যালগরিদম ডেভেলপ করলাম। এভাবেই শুরু।

স্বপ্নের প্রকল্পে এলো ফেলোশিপ

ইউনেসকো-ওডাব্লিউএসডি (অর্গানাইজেশন ফর উইমেন ইন সায়েন্স ফর দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড) ফেলোশিপও পেয়েছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে অটিজম শনাক্তকরণ এবং তাদের যোগাযোগকে সহজতরকরণের গবেষণায়। অটিজম জটিল নিউরোডেভেলপমেন্টাল ব্যাধিগুলোর একটি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুরা বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে থাকে। তারা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (ইশারা ভাষা) ব্যবহার করে। তবে বাংলাদেশে দক্ষ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অনুবাদক অপ্রতুল এবং এটা বেশ ব্যয়বহুল। এই জটিলতা নিরসনে ওয়াই-ফাই সিগন্যাল ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শনাক্তকরণে ডিজিটাল সহকারী সাইনকেয়ার তৈরি করা হবে। এ ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুদের সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা হবে।

প্রকল্পটি সফল হলে অটিস্টিক শিশুদের যোগাযোগের বাধা দূর হবে। যা তাদের অনুভূতি প্রকাশ এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে দারুণ কাজে দেবে। অভিভাবকরা খুব অল্প বয়সে সন্তানের অটিজম শনাক্ত করতে পারবেন। ফলে সেই শিশুদের সঙ্গে বাংলা ইশারা ভাষায় ভাব বিনিময় করতে পারবেন।

সুনন্দা বৈদ্যকেও অভিনন্দন

এই ফেলোশিপটির মেয়াদ তিন বছর। গবেষণা প্রকল্পের জন্য প্রত্যেক ফেলো সর্বোচ্চ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পাবেন। ফেলোশিপের অর্থায়ন করছে কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি)। উদ্দেশ্য আমাদের মতো গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষক ও গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা। ফেলোশিপের আওতায় নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও যোগাযোগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণও প্রদান করা হবে। আমার সঙ্গে এবার বাংলাদেশ থেকে একই ফেলোশিপ পেয়েছেন সুনন্দা বৈদ্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজীর শিক্ষক। তিনি মাথা-ঘাড়ের টিস্যু ও অঙ্গের ক্যান্সার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করবেন। বিশেষ করে এই ধরনের ক্যান্সারে টিএলআর ৪ (প্রোটিন)-এর ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করবেন। সুনন্দা তাঁর কাজের ব্যাপারে ভীষণ প্যাশনেট।

সেই মুহূর্তটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে

ফেলোশিপ নিতে গত ১৪ এপ্রিল ইতালির ট্রিয়েস্টে শহরে গেলাম। পুরস্কার গ্রহণের জন্য মঞ্চে উঠার মুহূর্তটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটা কেবল ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বিজ্ঞানে নারীদের জন্য এক সম্মিলিত বিজয়। কারণ, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের একজন তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণার জন্য আমার যে প্যাশন, তা বাস্তবে রূপ দিতে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ এবং বাধার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু সংকল্প, অধ্যবসায় আর পরিবারের সমর্থনের ফলে সব চ্যালেঞ্জ উতরে গিয়েছি। বিশেষ করে মা-বাবা পাশে না থাকলে এতদূর আসা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।

ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং এবং আইওটির ওপর গবেষণা ল্যাব ও রিসার্চ সেন্টার তৈরি করতে চাই। যেখানে শুধু বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নয়, সারা দেশের মেধাবীরা গবেষণার জন্য আসবে, এআইকে মানবকল্যাণে কাজে লাগাবে। এতে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর আমাদের নির্ভরতা কমবে।

ঊষার আলো-এসএ