UsharAlo logo
বুধবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাতক্ষীরায় বীজের বদলে বীজের গ্রাম

usharalodesk
মে ১৬, ২০২১ ৯:৩৯ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : প্রাচীনকালে কৃষক বাড়িতেই সংরক্ষিত করতো বিভিন্ন ফসলের বীজ। পরের বছর বপণের জন্য উৎপাদিত সবজি থেকে বিভিন্ন মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণের পাশাপাশি অন্যদের কাছে বিনিময় করতো। কিন্তু উপকূলীয় এলকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা কারণে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। পুনরায় সাতক্ষীরার কৃষকরা নতুন করে বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময় প্রথা চালু করেছে।
বীজের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে দুইশ’ প্রকারের বীজ সংরক্ষণ করেছেন ধুমঘাটের গণেষ মন্ডল। বিভিন্ন জাতের সবজি বীজসহ বৃক্ষের বীজ সংরক্ষণ করেছেন তিনি। পেশায় ধর্মীয় গুরু। তবে সময় পেলেই সংরক্ষণ করেন বিভিন্ন ধরনের বীজ। প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে চালু রেখেছেন বিনিময় প্রথাও। মানুষের প্রয়োজনে তিনি বীজ দিয়ে থাকেন এবং বীজের বিনিময়ে বীজই নেন।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এনামুল ইসলাম বলেন, চাষীরা আদিকাল থেকেই দেশি জাতের বীজ সংরক্ষণ করে আসছে। তবে বর্তমানে হাইব্রিড জাতের কারণে দেশি ফসলের চাষাবাদ কমেছে। ফলে দেশের কৃষিতে উৎপাদনের উন্নয়ন হলেও অনেক দেশি জাতের ফসলের বিলুপ্তি ঘটেছে। বেড়েছে কীটনাশকের ব্যবহার। এতে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষি বিভাগ এখন বিষ মুক্ত সবজি উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। বীজ সংরক্ষণ ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে গবেষণার পাশাপাশি কৃষকদের প্রশিক্ষণও চলমান রয়েছে।
জেলার শ্যামনগর উপজেলার ইশ্বরিপুর ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষাণী অল্পনা রাণী মিস্ত্রি দেশি বীজের বিলুপ্তি ঠেকাতে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন দেশীয় চারশ প্রজাতির শাক-সবজি ও ওষধি বীজ ভান্ডার। অল্পনা রাণীর মতোই বীজ সংরক্ষণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন উপকূলীয় এ এলাকার আরও অনেক কৃষক।

সরেজমিনে কৃষাণী অল্পনা রাণী মিস্ত্রির বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, উঠান জুড়ে বিভিন্ন ধরনের সবজির বীজ শুকাতে দিয়েছেন। বাড়ির সঙ্গেই বিষমুক্ত সবজি ক্ষেত, চারপাশে লাগানো রয়েছে বিভিন্ন জাতের দেশীয় ফলের গাছ।
কৃষাণী অল্পনা রাণী বলেন, ‘বাবা-ঠাকুরদার পেশা ছিল কৃষি। তাদের কাছেই বীজ সংরক্ষণ করতে শিখেছি। বিষ ছাড়াই পোকা মাকড় থেকে কীভাবে ফসল রক্ষা করতে হবে তা জানি। নিজে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করি। অন্যদেরও তা শেখাই। অনেক জাতের সবজি আজ বিলুপ্তির পথে। আমি কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশি জাতের বিভিন্ন প্রকার ধানসহ বিলুপ্তপ্রায় চারশ প্রকারের শাক-সবজি, ফলজ ও ওষধি গাছের বীজ সংগ্রহ করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের অন্য চাষিরা কেউ বীজ চাইলে দিতে পারি। এজন্য তাদের কাছ থেকে বীজের বিনিময়ে বীজ নিই। আমার কাছে কোনো না থাকলে অন্য বীজ দিয়ে বীজ নিয়ে আসি। হাইব্রিডের হাত থেকে কৃষিকে রক্ষা করতে হলে সরকারিভাবে দেশি প্রজাতির বীজ সংরক্ষণের বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।’
বিষয়টি এখন শুধু অল্পনা রাণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই ব্যাপ্তি এখন উপকূলের সচেতন কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষক এখন স্থানীয় এবং হাইব্রিড বীজের পার্থক্য জেনেছে।বীজ সংরক্ষণ করতে শিখেছে। বিষমুক্ত শাক সবজি উৎপাদনের পদ্ধতি শিখছে।
কৃষক শফিকুল গাইন বলেন, ‘লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় অনেক জাতের ধান ও সবজি এখন উৎপাদন হয় না। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর গাবুরা ইউনিয়নে লবণ পানি প্রবেশের পর ওই এলাকার অনেক জাতের ধান ও সবজি একেবারেই হারিয়ে গেছে। এখন বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। উপকূলের কৃষকরা এখন আগামীর কথা ভাবতে শুরু করেছে। সবাই এখন বীজ সংরক্ষণ করে।’

উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক-এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী পার্থ সারথি পাল বলেন, স্থানীয় জাতের বীজ স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে। লোকাল বীজ স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে টিকে থাকে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতিতে এ ধরনের বীজই সবচেয়ে উপযুক্ত। কৃষক বীজ নিজে সংরক্ষণ করতে পারলে একদিকে যেমন বাজারের প্রতি নির্ভরশীল হতে হয় না, অপরদিকে ফলনের একটা নিশ্চয়তা থাকে।
স্থানীয় কৃষক হরিপদ মন্ডল বলেন, স্থানীয় জাতের ধানসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের মাধ্যমে সবুজের সমারোহ থাকতো পুরো উপকূল জুড়ে। স্থানীয় জাতের একশর বেশি ধান থাকতো মাঠ জুড়েই। কালের বিবর্তনে সব কিছুই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে উপকূলের ঐতিহ্য। তবে এলাকার কিছু কিছু কৃষক কৃষির অতীতকে ফেরাতে চেষ্টা করছেন। আমরা তাদের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিষয়টিও শিখেছি।

(ঊষার আলো-এমএনএস)