ঊষার আলো ডেস্ক : হাতের নাগালেই দেদারছে বিক্রি হচ্ছে বিড়ি-সিগারেটসহ অন্যান্য তামাকজাত পণ্য। এসব দোকানে তামাকপণ্য বিক্রিতে করা হয় না বয়সের বাছ-বিচারও। তাই তামাকপণ্যের এই সহজলভ্যতার কারণে ধীরে-ধীরে এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে অপ্রাপ্ত বয়স্করা। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রকাশ্য ধূমপান এতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। অথচ আইনে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে প্রকাশ্য ধূমপানের। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এখনই যদি এর লাগাম টেনে না ধরা হয় তাহলে সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১২ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর ধূমপান করে থাকে; যাদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। বৈশ্বিক সংস্থাটি বলছে, ধূমপানে আসক্ত এই শিশুদের ৭৫ ভাগ ছেলে আর ২৫ ভাগ মেয়ে। বিজ্ঞাপনের প্রভাব এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে সিগারেট বিক্রি হওয়ার কারণেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধূমপানের প্রভাব বিস্তার করছে।
বেসরকারি মানবাধিকার ও গবেষণা সংস্থা ‘ভয়েস’ এর নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, আইন অনুযায়ী স্কুল-কলেজের একশ’ মিটারের মধ্যে কোনরকম দোকানে সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এমন নির্দেশনা দিয়েছে। অথচ এসব নির্দেশনা কেউ মানছে না। রঙ-বেরঙের চকোলেট বা অন্যান্য বাহারী পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সিগারেটগুলো এমনভাবে বিক্রি করছে যেন তা সহজেই শিশুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই সঙ্গে সময়োপযোগী আইন না থাকার অজুহাতে স্বল্পপুঁজির ব্যবসা হিসেবে ফেরি করেও সিগারেট বিক্রি করা হচ্ছে অহরহ। আর এতে করেও তামাকপণ্য থাকছে তরুণ প্রজন্মের হাতের নাগালেই।
তিনি অভিযোগ করেন, মূলত: কোম্পানিগুলো সচেতনভাবেই এইসব শিশু-কিশোরদের টার্গেট থাকে। এর কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো মনে করে অল্প বয়স থেকেই যদি শিশুদের সিগারেট ব্যবহার শুরু করিয়ে দেয়া যায়, তাহলে ওই প্রজন্ম অন্তত ৬০ বছর পর্যন্ত সিগারেট সেবনের অভ্যাসে জড়িয়ে পড়বে।
প্রকাশ্যে ধূমপানের বিরুদ্ধে আইনের বিধান থাকলেও রয়েছে তা কার্যকারিতার অভাব। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৪ (১) এ বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করতে পারবেন না। আইনের এমন সুস্পষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও মাঠপর্যায়ে তা কার্যকর করা হচ্ছে না। একইসঙ্গে যুগোপযোগী আইন না থাকার ফলে দেশে ই-সিগারেটের মত অসংখ্য নতুন ধোঁয়াযুক্ত-ধোঁয়াবিহীন মাদকের প্রভাব বাড়তে শুরু করেছে।
সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের দাবিতে ১৫২ জন সংসদ সদস্যের স্বাক্ষরকৃত একটি চিঠি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’ এর চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত ওই চিঠি হস্তান্তর করেন।
তিনি বলেন, আমরা ওই চিঠিতে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্তসহ সকল পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত পণ্য দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি বা সিএসআর নিষিদ্ধ করা, খুচরা সিগারেট বা বিড়ি বিক্রি বন্ধ, ই-সিগারেট আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ এবং তামাকপণ্য মোড়কজাতকরণে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের দাবি জানিয়েছি।
প্রকাশ্যে সিগারেট বিক্রি ও ধূমপানের ফলে অধূমপায়ীরা যেমন পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন, তেমনি তাদের অনেকেই আবার নতুন করে ধূমপানের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি চাওয়া মাত্রই যে কোনো দোকানে কিংবা সিগারেট হকারদের কাছে টাকা দিলেই মিলছে সিগারেট। এতে করে সময় কাটানোর উপায়ান্তর হিসেবে অনেকে সিগারেটকে বেছে নিচ্ছেন।
তবে ধূমপান নিয়ে এই খেয়ালিপনা চলতে থাকলে তা সামাজিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য সেক্টর ও ওয়াশ-এর পরিচালক ইকবাল মাসুদ। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করে দেখেছি, সিগারেট কোম্পানিগুলো অপ্রাপ্তবয়স্কদের নতুন করে ধূমপায়ী করে গড়ে তুলতে চায়। সেই উদ্দেশ্যে তারা সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্যগুলো দোকানে সিগারেট কোম্পানির আকর্ষণীয় বক্সের ভেতর প্রদর্শন করে রাখে এবং পয়েন্ট করে বিক্রি করে। এভাবে শিশুরা অল্প বয়সে সিগারেট থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অন্যান্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে প্রজন্মগুলো সিগারেট নির্ভর হয়ে পড়ায় নেমে আসে সামাজিকভাবে বিপর্যয়।
প্রকাশ্যে সিগারেট বিক্রির ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো কিছু কৌশল অবলম্বন করছে বলেও ‘গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে’ নামক ডব্লিউএইচও’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, দোকানে থাকা শিশুদের প্রিয় ও আকর্ষণীয় খাদ্য-খেলনা পণ্যের সঙ্গে সিগারেটের দৃশ্যমান উপস্থিতি, ক্রয়ের অবাধ সুযোগ রাখা এবং স্টিক প্রতি সিগারেট বিক্রি করায় ১৩ থেকে ১৫ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে ধূমপানের প্রভাব বেশি পড়ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আইন সংশোধনী কমিটির অন্যতম সদস্য ও ঢাকা আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি নীতিমালায় বেশকিছু বিধান রাখা সত্ত্বেও করোনার কারণে তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে সংশোধন না হওয়ায় পর্যন্ত বিদ্যমান আইনেই প্রকাশ্যে সিগারেটের ব্যবহার বন্ধের সুযোগ রয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণলায় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই ধূমপানমুক্ত এলাকার সীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকাশ্যে ধূমপান ও সিগারেট বিক্রি বন্ধ করতে পারে।
(ঊষার আলো-এমএনএস)